পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/২৬০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

236 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড গ্রামের দিকে। ঢাকা থেকে দীর্ঘ পথ। যানবাহন নেই। কখনো পায়ে হেঁটে, কখনো নৌকায়, এই দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে চলেছি। আমার একজন সহযাত্রী বন্ধু নিজের হ্যান্ডব্যাগের মধ্যে পুরে অতি সন্তৰ্পণে একটি রেডিও সেট নিয়ে এসেছিলেন। ফরিদপুরের দিকে পদায় আমরা নৌকা নিয়ে চলেছি। রেডিও সেটটি হাতে নিয়ে ঘুরাতে ঘুরাতে হঠাৎ শুনলাম, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়া বলছি। সহসা বুকের মধ্যে লাল রক্ত যেনো ফিনকি দিয়ে উঠলো। স্থানকাল ভুলে আমরা ক’জন সহযাত্রী আনন্দে একসংগে চিৎকার করে উঠলাম, চিৎকার করে উঠলাম আমরা বেঁচে আছি, আমরা বাঁচবো। হয়তো পদার বক্ষ থেকে আমাদের সেদিনের সেই উল্লাসধ্বনি ক্ষণিকেই বাতাসে মিলিয়ে গেছে। কিন্তু রক্তের মধ্যে সেদিন যে প্রবল উত্তাপ অনুভব করেছিলাম তা আজো ভোলা যায়নি। জানি না, যুদ্ধের জন্যে কখনো এমন হয় কিনা। এতো দিন নিজের মানসিকতা সম্পর্কে যতোটুকু সচেতন হয়েছি, তাতেও জানি যে নিরাপদ নিৰ্ব্বঞ্জাট জীবনের সপক্ষেই আমার মানসিক প্রস্তুতি। কিন্তু তা সত্ত্বেও সেদিন যুদ্ধের সংবাদে, আমাদের প্রতিরোধ সংগ্রামের ঘোষণায় পবিত্র আনন্দে ফেটে পড়েছিলাম। দীর্ঘ শীতরাত্রির নিরুত্তাপ নিঃশব্দ অন্ধকারের পর এই যেনো প্রথম আমাদের রক্তের মধ্যে দারুণ উত্তাপ বোধ করেছিলাম। যুদ্ধ কোনো মানুষকে এমন জীবিত করে তোলে এর আগে কখনো এমন ভাবতে পারিনি। পচিশে মার্চের সেই ভয়ংকর দুঃসহ অন্ধকার ২৬, ২৭ ও আটাশের দিবালোকেও ছিলো এরো বেশি স্পষ্ট, সমাচ্ছন্ন। আর বহু হাতড়িয়েও সে অন্ধকার থেকে আলোর সন্ধান পাচ্ছিলাম না। মনে হচ্ছিলো, নিজের সবকিছু নিয়ে সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশা ও এলামেলো ভাষারাজী নিয়ে ক্রমাগত যেনো কোথায় তলিয়ে যাচ্ছি; কোথায় তা জানিনে, তবে এটুকু বুঝতে পারছিলাম যে, ভয়ানক অস্বাভাবিক অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছি। দীর্ঘ পাঁচদিন পর এই আমাদের প্রথম ভোর হলো। জানিনে ইতিহাসে কারো জীবনে কখনো দীর্ঘ পাঁচ শেষ হয়েছিলো পুরো পাঁচদিন পরে। পুরো পাঁচদিন পর এই প্রথম বুঝলাম, ভোর হচ্ছে, আলো আসছে। অথচ আমরা তখন কোনো বন্দী শিবিরে ছিলাম না, ছিলাম না দেয়াল ঘেরা কারান্তরালে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যখন প্রথম শুনলাম আমরা যুদ্ধ করছি, বিশ্বাস করুন, আমার সমস্ত অনুভূতি দিয়ে তখনই কেবল অনুভব করলাম যে, দীর্ঘ পাঁচদিন পর ভোর হলো। তখন কেবল বোধ করলাম যে আমি বেঁচে আছি। নিজের পায়ে হাত দিলাম, রক্তের উত্তাপ নিলাম। দেখলাম আমি মরিনি। আমি তাই জানি না আর কোনো মানুষের যুদ্ধের সংবাদ এমন শিহরণ এনেছে কি না। কিন্তু আমি জানি, আমরা সেদিন অস্ত্র হাতে পথে না নামলে আমরা মরে যেতাম, এই মুক্তিযুদ্ধ গড়ে তুলে মাথা উচু করে না দাঁড়াতে পারলে আমরা মরে যেতাম। অথবা বেঁচে থাকতামথ- কিন্তু সে দুই-ই মৃত্যু। কারণ আমরা জানি, এ আমাদের বেঁচে থাকার যুদ্ধ, আমাদের অস্তিত্বের যুদ্ধ। আমাদের তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেন হানাদার দুসু্যদের অধিকৃত অঞ্চলে ঢুকে তাদের ওপর মরণ আঘাত হেনে। তারা যুদ্ধ করেন, এক- একটি অঞ্চল মুক্ত করেন হানাদার দসু্যদের পাপপঙ্কিল অধিকার থেকে। সেখানে উড়িয়ে দেন বাংলাদেশের ভালোবাসার বিজয় পতাকা। সেখানে খুলে দিয়ে আসেন আমাদের উত্তর পুরুষের আগামী সুখীস্বচ্ছন্দ ও নিরাপদ জীবনের সোনালি স্বপ্ন, ওরা তাই যুদ্ধ করে; যুদ্ধ করে বাঁচে, যুদ্ধ করে মরে- মরেও বেঁচে থাকে। আমরা বেঁচেও মেরে ছিলাম, তাই আমরা যুদ্ধ করছি- আমরা মরেও বেঁচে থাকবো। তাই আমরা রক্ত দিচ্ছি, আমরা রক্ত দিয়ে রেখে গেলাম আমাদের অস্তিত্ব, আমাদের দুর্জয় স্বপ্নের ফুল। ফ্রন্টে আমাদের মুক্তিসেনারা অবিরাম যুদ্ধ করছে আমাদের বেঁচে থাকার জন্য; ঘরে আমাদের জায়া-জননী, ভগ্নীরা যুদ্ধ করছে আমাদের বেঁচে থাকার জন্য, শরণার্থী শিবিরে শিবিরে লক্ষ লক্ষ নির্যাতিত মানুষ প্রতিনিয়ত জীবনের সংগে যুদ্ধ করছে বেঁচে