পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/২৮২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

258 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড গতিবিধির। তারপর স্ট্রাটেজী ঠিক করে মুক্তিযোদ্ধাদের পাঠান এ্যাকশনে, মাঝে মাঝে তিনি নিজেও এ্যাকশনে যান, তবে তা নির্ভর করে এ্যাকশনের গুরুত্বের উপর। দোহারা চেহারার লোক এই ক্যাপ্টেন বা কম্যাণ্ডার। তাকে আগে কোথায় দেখেছি বলে আবছা আবছা মনে পড়তে লাগল। কিন্তু স্মরণ করতে পারলাম না। তবে তিনি আমাকে দেখেই বলে ফেললেন। বললেন, রহমতের খবর কি? বললাম, ২৩শে মার্চ পর্যন্ত তার খবর জানতাম। বিজলীদের দেশে পাঠিয়ে দিয়ে সে সময় রহমত ঢাকায় ছিল। তারপর আর কিছু জানি না। সাথে সাথে মনে পড়ল এ ক্যাপ্টেনকে ঢাকা মেডিক্যাল পুরোভাগে। তাছাড়া, তাকে দেখেছি সংবাদপত্রের রিপোর্টারদের টেবিলে। কলেজ ছাত্র সংসদের খবর নিয়ে তিনি যেতেন রিপোর্টারদের কাছে। বললাম, আপনি ত ডাক্তার হয়েছেন, শুনেছি আর্মি মেডিক্যাল কোরে গিয়েছেন। আর এখন দেখছি কম্যাণ্ডারগিরি করছেন। হেসে বললেন, ‘এখন দরকার এ্যাকশনের, যুদ্ধের। তাই জল্লাদের আর্মি মেডিক্যাল কোর থেকে পালিয়ে এসে যুদ্ধে নেমেছি।”....... মার্চ-এপ্রিলের মত আজ আর আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা আনাড়ী যোদ্ধা নয়। তারা আজ পুরাপুরি ট্রেনিংপ্রাপ্ত। তারা আজ মেশিনগান চালাতে পারে, মর্টার চালাতে পারে এবং গ্রেনেড ও ডিনামাইট ব্যবহার করতে পারে। প্রয়েজনীয় অস্ত্র হাতে থাকলে এদের দশজন অন্তত একশো-দুশো শত্রসেনাকে ঘায়েল করতে পারে। ক্যাপ্টেন ও তাদের কয়েকজনের সাথে আলাপ করে দেখলাম ওরা নির্ভয়, মৃত্যুকে ওরা আজ পরোয়া করে না। মৃত্যুর সাথে ওরা আজ পাঞ্জা লড়তে প্রস্তুত। কথাটা ক্যাপ্টেন নিজেও আমাকে এক পর্যায়ে বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ওদের নিয়ে আমাকে অসুবিধায়ও পড়তে হয় অনেক বাঘ যেমন নরমাংসের গন্ধ পেলে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে, তেমনি ওরাও কোনস্থানে শত্রপক্ষের উপস্থিতির খবর পেলে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। শত্রর কাছে কি অস্ত্র আছে আর ওদের কাছে কি আছে তার বাছবিচার ওরা করতে চায় না।’ ক্যাম্প থেকে ফিরে আসছি, এমন অতি পরিচিত একজন মুক্তিযোদ্ধা কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা মতিন ভাই, আমাদের মুজিব ভাই কি বেঁচে আছেন? ওনাকে কি ফিরে পাব?” এ প্রশ্নে নতুনত্বের কিছু ছিল না। এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় প্রতিদিন অসংখ্যবার। তবু তাকে বললাম, তিনি ত বলে গেছেন, তিনি হকুম দিতে না পারলেও যেন আমরা নিজ নিজ কৰ্তব্য করে যাই। সুতরাং বর্তমান সময় ওসব বিচার না করে তিনি যা চেয়েছিলেন তা সমাধা করায় আত্মনিয়োগ করাই কি শ্রেয় নয়? তিনি বললেন, “তা ত ঠিক। আমরা তাই করছি এবং করে যাব। প্রয়োজনবোধে প্রাণ দেব। কিন্তু মুজিব ভাইকে ছাড়া যে বাংলাদেশের অস্তিত্বই চিন্তা করতে পারি না! জানেন, আমার বাবা ও দুই ভাইকে ঘাতকরা হত্যা করেছে। তবু বেঁচে আছি। কিন্তু মুজিব ভাইকে হারালে যে বাঁচতে পারব না।’

  • * * * * * সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

ক্যাম্পে কিছু সময় কাটানোর পর ক্যাপ্টেনের তাঁবুতে ফিরে আসলাম। তিনি আমাকে একজন সুবেদার মেজরের হাওলা করে দিয়ে বললেনঃ ‘ওনার সাথে কথা বলুন, আমরা শিকারে যাচ্ছি।’