পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড).pdf/৬৪১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খণ্ড
৬১৬

আনুপাতিক প্রয়োজনের সংগে তার কোন সঙ্গতি নেই। ১৯৫৮-৫৯ সাল পর্যন্ত পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার যে অর্থ সাহায্য করেছেন, তা থেকেই এ কথার সত্যতা নিরূপণ করা যায়। আলোচ্য সময় পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিম পাকিস্তানকে যে ক্ষেত্রে ৫২ কোটি ৫৮ লক্ষ টাকা সরাসরি সাহায্য দিয়েছেন, পূর্ব পাকিস্তানকে সে ক্ষেত্রে দিয়েছেন ২৬ কোটি ৫২ লক্ষ টাকা।

 প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, দেশ বিভাগের আগে পূর্ব পাকিস্তানেও কয়েকটি উন্নয়ন পরিকল্পনার কাজ চলছিল। বাংলা প্রদেশের এ সকল উন্নয়ন পরিকল্পনা কার্যকরী করার জন্য তদানীন্তন ভারত সরকার ৭০ কোটি টাকা সাহায্য মঞ্জুর করেন। এই অর্থের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাপ্য হতো অন্যূন ৫০ কোটি টাকা। কিন্তু পাকিস্তান সরকার উন্নয়ন পরিকল্পনাসমূহের জন্য অর্থ সাহায্য দেওয়া বন্ধ করে দিয়ে বলেন যে, উন্নয়ন পরিকল্পনা বাবদ প্রাদেশিক সরকারকে ঋণ মঞ্জুর করা হবে।

 ঋণ দানের ক্ষেত্রেও পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি সুবিচার করা হয়নি। ১৯৫৭-৫৮ সাল পর্যন্ত উন্নয়ন পরিকল্পনাসমূহ কার্যকরী করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তান যেখানে ঋন পেয়েছে ৯৮ কোটি ২৩ লক্ষ টাকা, পূর্ব পাকিস্তান সেখানে পেয়েছে মাত্র ৪৫ কোটি ৭৭ লক্ষ টাকা। বিদেশ থেকে প্রাপ্ত সাহায্য পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে কিভাবে বণ্টন করা হয়েছে, তার আনুপাতিক হার সম্পর্কে সঠিক কোন তথ্য পাওয়া যায় না। তবে যে সকল আভাস পাওয়া যাচ্ছে তা থেকে ধরে নেয়া যেতে পারে যে, এ ক্ষেত্রেও পূর্ব পাকিস্তান তার ন্যায্য অংশ পায়নি। প্রকৃতপক্ষে শূন্যের কোঠা থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের জীবনযাত্রার শুরু। এমতাবস্থায়, পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্নমুখী ঘাটতি পূরণের জন্য এখানকার জনসংখ্যা এবং বৈষয়িক ও আর্থিক অসচ্ছলতার কথা বিবেচনা করে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রদত্ত সরাসরি সাহায্য, বৈদেশিক সাহায্য ও উন্নয়ন খাতে মঞ্জুরীকৃত ঋণের অন্যূন শতকরা ৫০ ভাগের বেশী পূর্ব পাকিস্তানেরই পাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তা হওয়া তো দূরের কথা- এই প্রদেশ কেবল অবহেলাই পেয়ে এসেছে। প্রদেশের বর্তমান শোচনীয় আর্থিক অবস্থা এই অবহেলারই ফল।

 কেন্দ্রীয় সরকারের রাজস্ব খাতের ব্যয় বরাদ্দের ক্ষেত্রে ও পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি অত্যন্ত অবিচার করা হয়েছে। ১৯৫৬-৫৭ সাল পর্যন্ত এই খাতের ব্যয় বরাদ্দের তুলনামূলক বিবরণ থেকে এটা পরিস্কার হয়ে পড়েছে। আলোচ্য সময় পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের জন্য যেখানে ব্যয় করা হয় মাত্র ৬৩ কোটি টাকা সেখানে পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য ব্যয় করা হয় ৮১ কোটি টাকা।

দেশরক্ষা-

 দেশরক্ষা খাতের ব্যয় বরাদ্দের চিত্র আরও নৈরাশ্যজনক। ১৯৫৬-৫৭ সাল পর্যন্ত দেশরক্ষা বাবদ পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয় করা হয় কিঞ্চিদধিক ১৮ কোটি টাকা, অপরপক্ষে পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় করা হয় ৪৮০ কোটি টাকা। এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, দেশ বিভাগকালে পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানের অবস্থা সব দিক দিয়েই সন্তোষজনক ছিল। সুতরাং এ প্রদেশের দেশরক্ষা ব্যবস্থা উন্নয়ন ও শক্তিশালী করার দিকে আরও বেশী নজর দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, পূর্ব পাকিস্তানকে তার অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য নিরবচ্ছিন্ন কঠোর সংগ্রামের পথেই ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। ফলে, তার পক্ষে জাতি গঠনমূলক কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজে হাত দেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এ ক’বছরে পূর্ব পাকিস্তানে তেমন কোন বড় রকমের উন্নয়ন পরিকল্পনা কার্যকরী না হওয়ায় এখানকার আর্থিক অবস্থার বিশেষ কোন উন্নতি হয়নি। আমি আগেই বলেছি, এ সব অসুবিধা সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তান সরকার তাঁদের নিয়ন্ত্রণাধীন বিভিন্ন খাতের আয় বৃদ্ধির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে এসেছেন। আয় বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে সরকার বিগত ১০ বছরে ৩০টি নয়া কর ধার্য করেছেন অথচ সাধারণের আর্থিক মানের উন্নতি না হওয়ায় অধিক করভার বহনের ক্ষমতাও তাদের নেই। যে পরিমাণ সাহায্য করা উচিত ছিল, কেন্দ্রীয় সরকার তা করেননি। সিএসপি অফিসারদের বেতন ও ভাতা বৃদ্ধি এবং গভর্ণরকে আর বেশী সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার উদ্দেশ্যে কেন্দ্রীয় সরকার প্রাদেশিক সরকারের উপর কতিপয় ব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়ায়