জ্ঞানে বিবিধ আনন্দোৎসব করিতেছে, কিন্তু ভ্রমেও ভাবনা করে না যে সেসব উৎসব শব হইলে কি হইবে।[১]
তার পরে বিদ্যাসাগর এই কাঁচা ভাষায় চেহারার শ্রী ফুটিয়ে তুললেন। আমার মনে হয় তখন থেকে বাংলা গদ্যভাষায় রূপের আবির্ভাব হল।
আশ্চর্যের বিষয় এই যে, যিনি ঈশ্বর গুপ্তের আসরে প্রথম হাত পাকাচ্ছিলেন অত্যন্ত আড়ষ্ট বাংলা ভাষায়, সেই ভাষারই বন্ধন মোচন করেছিলেন সেই বঙ্কিম। তিনিই তাকে দিয়েছিলেন চলবার স্বাধীনতা।
আমরা পুরাতন সাহিত্যে পেয়েছি পদ্য, সেইটেই বনেদি। কিন্তু এ কথা বলা ঠিক হবে না, সাধু ভাষার আদর্শ ছিল তার মধ্যে। ভাষাকে ছন্দে-ওজন-করা পদে বিভক্ত করতে গেলে তার মধ্যে স্বাভাবিক কথা বলার নিয়ম খাটে না, ক্রমে তার একটা বিশেষ রীতি বেঁধে যায়। প্রথমত কর্তা-কর্ম-ক্রিয়াপদের সহজ পর্যায় রক্ষা হতেই পারে না। তার পরে তার মধ্যে কতকগুলি পুরোনো শব্দ ও রীতি থেকে যায়, ছন্দের আশ্রয় পেয়ে যারা কালের বদল মানে না। চারটে লাইন পদ্য বানিয়ে তার দৃষ্টান্ত দেখানো যাক—
কার সনে নাহি জানি করে বসি কানাকানি,
সাঁঝবেলা দিগ্বধূ কাননে মর্মরে।
আঁচলে কুড়ায়ে তারা কী লাগি আপনহারা,
মানিকের বরমালা গাঁথে কার তরে।
এই কটা লাইনকে সাধুভাষায় ঢালাই করতে গেলে হবে এইরকম—সন্ধ্যাকালে দিগ্বধূ অরণ্যমর্মরধ্বনিতে কাহার সহিত বিশ্রম্ভালাপে প্রবৃত্ত তাহা জানি না। জানি না কী কারণে ও কাহার জন্য আত্মবিহ্বল অবস্থায় সে আপন বস্ত্রাঞ্চলে নক্ষত্র সংগ্রহপূর্বক মাণিক্যের বরমাল্য গ্রন্থন করিতেছে।
- ↑ সংবাদপ্রভাকর, ২৩ এপ্রিল, ১৮৫২। –বঙ্কিমচন্দ্রের রচনাবলীর বঙ্গীয় সাহিত্য-পরিষৎ কর্তৃক প্রকাশিত বঙ্কিম-শতবার্ষিক, সংস্করণ, বিবিধ খণ্ড, পৃ ৬৮