পাতা:বাংলাভাষা পরিচয়-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৮৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাভাষা-পরিচয়

বেশি। সংস্কৃতে আছে, ‘পতনোন্মুখ’, বাংলায় বলে ‘পড়ো-পড়ো’। সংস্কৃতে যা আসন্ন বাংলায় তা ‘হব-হব। সেইরকম: গেল-গেল, যায়-যায়। সংস্কৃতে যা ‘বাষ্পাকুল’ বাংলায় তা ‘কাঁদো-কাঁদো’। সংস্কৃতে বলে ‘অবরুদ্ধস্বরে’, বাংলায় বলে ‘বাধো-বাধো গলায়’। বাংলায় ঐ কথাগুলোতে কেবল যে একটা ভাব পাওয়া যায় তা নয়, যেন ছবি পাই। ' একটা শ্লোক বলা যাক—

যাব-যাব করে, চরণ না সরে,
ফিরে-ফিরে চায় পিছে,
পড়ো-পড়ো জলে ভরো-ভরো চোখ
শুধু চেয়ে থাকে নীচে।

 ঠিক এরকম একটুকরো রেখালেখ্য এই বাধো-বাধো ভাষাতেই বানানো চলে। বাংলায় বণনার ছবিকে সপস্ট করবার জন্যেই এই-যে অস্পষ্ট ভাষার কায়দা, এর কথা বাংলা শব্দতত্ত্ব গ্রন্থে ধ্বনাত্মক শব্দের আলোচনায় আরও বিস্তারিত করে বলেছি।[১]

 বাংলায় কোনো কোনো প্রত্যয় অর্থগত ব্যবহার অতিক্রম ক’রে এইরকম ইঙ্গিতের দিকে পৌঁচেছে, তার উল্লেখ করা যাক: কিপ্‌টেমো ছিব্‌লেমো ছেলেমো জ্যাঠামো ঠ্যাঁটামো ফাজ্‌লেমো বিট্‌লেমো পেজোমো হ্যাংলামো বোকামো বাঁদ্‌রামো গোঁড়ামো মাৎলামো গুণ্ডামো।

 সংস্কৃতের কোন্‌ প্রত্যয়ের সঙ্গে এর তুলনা করব? ত্ব প্রত্যয় দিয়ে ‘কিপ্‌টেমো’কে ‘কিপ্‌টেত্ব’ বলা যেতে পারে। কিন্তু ত্ব প্রত্যয় নির্বিকার, ভালো-মন্দ প্রিয়-অপ্রিয় জড়-অজড়ে ভেদ করে না। অথচ উপরের ফর্দটা দেখলেই বোঝা যাবে, শব্দগুলো একেবারেই ভদ্রজাতের নয়। গাল-বর্ষণের জন্যেই যেন পাঁকের পিণ্ড জমা করা হয়েছে। ঐ মো বা আমো প্রত্যয়ের যোগে ‘বাঁদরামো’ বলি, কিন্তু ‘সিংহমো’ বলি নে। ‘কিপ্‌টেমো’ হল, ‘দাতামো’ হল না।

৮০
  1. রবীন্দ্র-রচনাবলী, দ্বাদশ খণ্ড, পৃ. ৩৭৪।