পাতা:বাংলায় ভ্রমণ -দ্বিতীয় খণ্ড.pdf/৬০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

88 বাংলায় ভ্রমণ যুগেও নারায়ণগঞ্জ একটি বন্দর ছিল ; তখন ইহার কি নাম ছিল ঠিকৃ জানা নাই। কথিত আছে, ঈস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী ভিখনলাল ঠাকুর কোনও সন্ন্যাসীর নিকট হইতে পাঁচটি নারায়ণ চক্ৰ পাইয়া একটি এই স্থানে, একটি পুরাতন ব্ৰহ্মপুত্র কুলে পঞ্চমী ঘাটে, একটি ইদ্রাকপুরে ও একটি ঢাকার লক্ষ্মী বাজারে ও আর একটি নরসিংহজীর আখড়ায় স্থাপিত করেন। এই বন্দরের আয় হইতে এই পাঁচটি নারায়ণ বিগ্রহের সেবার ব্যবস্থা করেন বলিয়া স্থানটির নাম নারায়ণগঞ্জ হইয়াছে। নারায়ণগঞ্জ নগর এখন শীতলক্ষ্যার উভয় তীরে অনেক দূর পর্যন্ত ছড়াইয়া পড়িয়াছে। এখানে বহু পাটের কল, ঢাকেশ্বরী ও লক্ষ্মীনারায়ণ প্রভৃতি কাপড়ের কল, কাচের কল ইত্যাদি স্থাপিত আছে। প্রতি বৎসর লক্ষ লক্ষ টাকার পাট এখান হইতে রপ্তানি হয়। শীতলক্ষ্যার পশ্চিমকুলে রেল স্টেশন, হাজীগঞ্জ, ভগবান গঞ্জ, তান বাজার প্রভৃতি মহাল্লা এবং পূর্বকূলে নবীগঞ্জ, সোনাকান্দা, মদনগঞ্জ প্রভূতি শহরের অংশ অবস্থিত। প্রসিদ্ধ বাগ্মী বিপিনচন্দ্র পাল মহাশয় পঞ্চাশ বৎসর পূবেৰ নারায়ণগঞ্জ কিরূপ ছিল, সে সম্বন্ধে লিথিয়াছেন—“ আমি প্রথমে যে নারায়ণগঞ্জ দেখিয়াছিলাম, সে নারায়ণগঞ্জ আজ আর নাই। সে নারায়ণগঞ্জ ছিল একটা গ্রাম ও বাজার। আজিকার নারায়ণগঞ্জ হইয়াছে একটা বড় বন্দর ও সহর । ঢাকা—নারায়ণগঞ্জে তখনও রেল হয় নাই। পাটের গুদাম দুই একটা হইয়াছে। বোধ হয় রালী ব্রাদার্সের আফিস বসিয়াছে। আর ছাতকের ইংলিস কোম্পানীর বড় একটা আফিস ছিল। নারায়ণগঞ্জে তখন হোটেল ছিল না । কতকগুলি আখড়া ছিল। এই সকল আখড়াতেই যাত্রীরা আশ্রয় ও আহার পাইত। এজন্য যথাসম্ভব প্রণামী দিতে হইত। এই প্রণামীর উপরে প্রসাদের গুণাগুণ নির্ভর করিত। সামান্য প্রণামী দিলে সাধারণ ডাল ভাত মিলিত; বেশী প্রণামী দিলে উৎকৃষ্ট আতপান্ন, গব্য ঘৃত, দৈ, সর, দুধ এবং মিষ্টানু মিলিত। আখড়ার নাট-মন্দিরে শুইবার স্থান মিলিত । গত পঞ্চাশ বৎসরে ইহার শ্রী ফিরিয়া গিয়াছে। ” শহরের নবীগঞ্জ মহাল্লায় কদম রসুল বা হজরৎ মহম্মদের পদচিহ্নযুক্ত একখণ্ড প্রস্তর একটি সৌধ মধ্যে রক্ষিত আছে। বার ভূঁইয়ার অন্যতম প্রধান ভূঁইয়া সুপ্রসিদ্ধ ঈশা খার প্রপৌত্র মানোয়ার খ। খৃষ্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ইহা নিৰ্মাণ করেন এবং ১৬৪২ খৃষ্টাব্দে গোলাম নবী নামক একজন মুঘল কৰ্ম্মচারী কর্তৃক ইহা পুননিৰ্ম্মিত হয়। শহরের হাজীগঞ্জ ও সোনাকান্দা মহাল্লায় দুইটি পুরাতন গোলাকার জলদুর্গের ভগ্নাবশেষ দৃষ্ট হয় মুনসীগঞ্জের নিকটস্থ প্রসিদ্ধ কলাগাছিয়া সঙ্গমের উপর ইদ্রাকপুরে ঠিক অনুরূপ একটি জলদুর্গের ভগ্নাবশেষ আছে। ইহাদের মধ্যে সোনাকান্দার দুগটি দেখিলে পূবর্বাবস্থা বুঝিতে পারা যায়, বর্ষাকালে এখনও দুর্গটির চারিদিকে নৌকাযোগে ঘোরা যায়; গোল দেওয়ালে একহাত দুইহাত অস্তর কামান বসাইবার ছিদ্র এবং একটি মুচর্চার উপর বড় কামান বসাইবার স্থান। সম্রাট আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে বাংলার সুবাদার মীর জুমলা কর্তৃক পর্তুগীজ ও মগ দসু্যদের আক্রমণ হইতে রাজধানী ঢাকা নগরী দৃঢ়ভাবে রক্ষা করিবার জন্য এই তিনটি দুর্গ নিৰ্ম্মিত হইয়াছিল। এই জাতীয় জলদুর্গ বোম্বাই প্রদেশের থানা জেলা ভিন্ন ভারতবর্ষের আর কোথাও দৃষ্ট হয় না। হাজীগঞ্জের দুর্গটি পরিধিতে প্রায় দেড় মাইল এবং উহা এখন ঢাকার নবাবদের হাফেজ মঞ্জিল নামক বাগানের মধ্যে পড়িয়াছে। সম্ভবতঃ মীর জুমলার পূবেবও এখানে একটি দুগ ছিল। প্রবাদ বার ভূঁইয়ার অন্যতম সুপ্রসিদ্ধ চাদরায়ের কন্যা ও ঈশা খার পত্নী সোনা বিবি এই দুর্গে থাকিয়া মগ দিগের সহিত সবিক্রমে যুদ্ধ করিয়াছিলেন এবং নিশ্চিত পরাজয় বুঝিয়া অগ্নিকুণ্ডে প্রাণ বিসজৰ্জন দিয়াছিলেন।