পাতা:বাংলা বানানের নিয়ম (তৃতীয় সংস্করণ) - কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়.pdf/৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

[ ৩ ]

ব্যতীত সকলেই দ্বিত্ববর্জনের পক্ষে। কয়েকজন প্রবীণ লেখক বহুকাল হইতে তাঁহাদের লেখায় দ্বিত্ব পরিহার করিয়াছেন। আজকাল বঙ্গদেশে প্রকাশিত অনেক সংস্কৃত পুস্তকে দ্বিত্ব বর্জিত হইয়াছে।

 কেহ কেহ বলেন, বাংলা উচ্চারণে রেফাক্রান্ত বর্ণে অতিরিক্ত জোর পড়ে, সেজন্য দ্বিত্ব আবশ্যক; ‘সর্ব্ব’—‘সর্ + ব’ নয়, ‘সর্ + ব্ব’। এই যুক্তি নিতান্ত অসার, কারণ অন্যান্য যুক্তাক্ষরে যে জোর পড়ে, রেফাক্রান্ত বর্ণে তাহার অধিক পড়ে না। ‘ভক্তি’ ও ‘ভর্ত্তি’র উচ্চারণে জোরের তারতম্য নাই; অনুরূপ—‘স্বপ্ন, সর্ব্ব; কল্মষ, কর্ম্মঠ, উদ্বোধ, দুর্ব্বোধ; পল্‌তা, পর্দা’। ‘সর্গ, সর্প, সর্ব্ব’ শব্দে দ্বিত্ব থাকায় না-থাকায় জোরের ইতরবিশেষ হয় না; অনুরূপ—‘অর্থ, অর্দ্ধ; কর্পূর, কর্ব্বূর; গর্ভ, গর্ব্ব, নির্ঝর, নির্জ্জর’। অতএব ‘সর্ব, পর্দা, অর্ধ, গর্ব’ প্রভৃতি লিখিলে কিছুমাত্র ক্ষতি হইবে না। আর এক আপত্তি—অনেকে ‘কার্য্য’ শব্দের উচ্চারণ ‘কাইর্জ’ তুল্য করিয়া থাকেন; ‘কার্য’ লিখিলে ‘কার্জ’ উচ্চারণের আশঙ্কা আছে। ‘কাইর্জ’ বা ‘কার্জ’ কোন্ উচ্চারণ ভাল তাহার বিচার অনাবশ্যক। যাঁহারা ‘কাইর্জ’ উচ্চারণ করিয়া থাকেন য-ফলা বাদ দিয়া ‘কার্য’ লিখিলেও তাঁহারা অভীষ্ট উচ্চারণ করিতে পারিবেন। ‘কাল’ (সময়) এবং ‘কাল’ (কল্য) এই দুই শব্দের উচ্চারণ কলিকাতা অঞ্চলে সমান, কিন্তু বাংলা দেশের বহুস্থলে ‘কাল’ (কল্য) শব্দের উচ্চারণ ‘কাইল’ তুল্য। যাঁহারা শেষোক্ত উচ্চারণ করেন তাঁহাদের য-ফলা বা অন্য চিহ্নের প্রয়োজন হয় না, শব্দটি চিনিয়াই তাঁহারা অনায়াসে অভ্যস্ত উচ্চারণ করেন। অতএব, ‘কার্য’ লিখিলে অভীষ্ট উচ্চারণ আসিবে না, এই আশঙ্কা অমূলক। কেহ কেহ বলেন, যখন রেফের পর দ্বিত্ব করা বা না করা উভয়ই ব্যাকরণ সম্মত তখন বিকল্পের ব্যবস্থা রাখাই ভাল। অনেক সংস্কৃত শব্দের দুই প্রকার বানান অভিধানে আছে, যথা—‘ধরণী, ধরণি, মহী, মহি; ঊর্ণা, উর্ণা’। কিন্তু বাংলা প্রয়োগে এক প্রকার বানানই দেখা যায়, অন্যটি প্রায় অচল হইয়া আছে। রেফাক্রান্ত বর্ণের দ্বিত্ব বিকল্পে বিহিত হইলে অভ্যস্ত বানানই রহিয়া যাইবে এবং নিয়মরচনা নিষ্ফল হইবে। পক্ষান্তরে কেবল বর্জনের বিধি থাকিলে অসংখ্য শব্দের বানানে সরলতা আসিবে।

 তদ্‌ভব শব্দে অনেকে মূল অনুসারে ণ প্রয়োগ করেন, যথা— ‘কাণ, সোণা’। কিন্তু সকল শব্দে এই রীতি অনুসৃত হয় না, যথা— ‘বামুন, গিন্নী’। বাংলা ক্রিয়াপদেও ণত্ব হয় না, যথা— ‘শোনা, করেন, করুন’। বহু বিশিষ্ট লেখক ‘কান, সোনা’ প্রভৃতি লিখিয়া থাকেন এবং এই রীতি ক্রমে ক্রমে বিশেষ প্রচলিত হইতেছে। ‘কোরাণ, গভর্ণর’ প্রভৃতিতে ণত্ব করিবার কোনও হেতু নাই। যাঁহারা বানান-বিষয়ক প্রশ্নপত্রের উত্তর দিয়াছেন তাঁহাদের অধিকাংশ ণ বর্জনের পক্ষে। অ-সংস্কৃত শব্দে ণ বর্জন করিলে বানান সরল হইবে। ‘রাণী’ বানান অনেকেই রাখিতে চান, এজন্য এই শব্দে বিকল্প বিহিত হইয়াছে।

 অভ্যন্ত রীতির পরিবর্তনে অল্পাধিক অসুবিধা হইতে পারে, কিন্তু কেবল সেই কারণে নিশ্চেষ্ট থাকিলে কোনও বিষয়েরই সংস্কার সাধ্য হইবে না। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়