পাতা:বিবিধ-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৯৫৯).pdf/৬১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিদ্যাপতি ও জয়দেব (NO) সৃষ্ট হইল। সেই গীতিকাব্যও উচ্চাভিলাষশূন্য, অলস, ভোগাসক্ত, গৃহসুখপরায়ণ। সে কাব্যপ্ৰণালী অতিশয় কোমলতাপূর্ণ, অতি সুমধুর, দম্পতিপ্ৰণয়ের শেষ পরিচয়। অন্য সকল প্রকারের সাহিত্যকে পশ্চাতে ফেলিয়া, এই জাতিচরিত্রানুকারী গীতিকাব্য সাত আট শত বৎসর , পৰ্য্যন্ত বঙ্গদেশে জাতীয় সাহিত্যের পদে দাড়াইয়াছে। এই জন্য গীতিকাব্যের এত বাহুল্য । বঙ্গীয় গীতিকাব্যলেখকদিগকে দুই দলে বিভক্ত করা যাইতে পারে। এক দল, প্রাকৃতিক শোভার মধ্যে মনুস্যকে স্থাপিত কািরয়া তৎপ্রতি দৃষ্টি করেন ; আর এক দল, বাহা প্ৰকৃতিকে দূরে রাখিয়া কেবল মনুস্থ্যহাদয়কেই দৃষ্টি করেন। এক দল মানবহৃদয়ের সন্ধানে প্ৰবৃত্ত হইয়া বাহা প্ৰকৃতিকে দীপ করিয়া তদালোকে অন্বেষ্য বস্তুকে দীপ্ত এবং প্ৰস্ফুট করেন ; আর এক দল, আপনাদিগের প্রতিভাতেই সকল উজ্জল করেন, অথবা মনুষ্যচরিত্র-খনিতে যে রত্ন মিলে, তাহার দীপ্তির জন্য অন্য দীপের আবশ্যক নাই, বিবেচনা করেন। প্রথম শ্রেণীর প্রধান জয়দেব, দ্বিতীয় শ্রেণীর মুখপাত্র বিদ্যাপতিকে ধরিয়া লওয়া যাউক । জয়দেবাদির কবিতায় সতত মাধবী যামিনী, মলয়সমীর, ললিতলতা, কুবলয়দলশ্রেণী, স্ফুটিত কুসুম, শরচ্চন্দ্ৰ, মধুকরবৃন্দ, কোকিলাকৃজিত কুঞ্জ, নবজলধর, এবং তৎসঙ্গে, কামিনীর মুখমণ্ডল, ভ্ৰাবল্লী, বাহুলতা, বিম্বৌষ্ঠ, সরসী রুহলোচনা, অলসনিমেষ, এই সকলের চিত্র, বাতোনুথিত তটিনীতিরঙ্গবৎ সতত চাকচিক্য সম্পাদনা করিতেছে। বাস্তবিক এই শ্রেণীর কবিদের কবিতায় বাহ্যু প্ৰকৃতির প্রাধান্য । বিদ্যাপতি যে শ্রেণীর কবি, র্তাহাদিগের কাব্যে বাহা প্ৰকৃতির সম্বন্ধ নাই, এমত নহে-বাহা প্ৰকৃতির সঙ্গে মানবহৃদয়ের নিত্য সম্বন্ধ, সুতরাং কাব্যেরও নিত্য সম্বন্ধ ; কিন্তু তাহাদিগের কাব্যে বাহা প্ৰকৃতির অপেক্ষাকৃত অস্পষ্টত লক্ষিত হয়, তৎপরিবৰ্ত্তে মনুস্যহৃদয়ের গৃঢ় তলচারী ভাবসকল প্রধান স্থান গ্ৰহণ করে। জয়দেবাদিতে বহিঃপ্রকৃতির প্রাধান্য, বিদ্যাপতি প্ৰভৃতিতে অন্তঃপ্রকৃতির রাজ্য। জয়দেব, বিদ্যাপতি, উভয়েই রাধাকৃষ্ণের প্রণয়কথা গীত করেন। কিন্তু জয়দেব যে প্ৰণয় গীত করিয়াছেন, তাহ বহিরিান্দ্ৰিয়ের অনুগামী । বিদ্যাপতি প্ৰভৃতির কবিতা, বিশেষতঃ চণ্ডীদাসাদির কবিতা বহিরিতিদ্বয়ের অতীত। তাহার কারণ, কেবল এই বাহিত্যু প্ৰকৃতির শক্তি। স্থূল প্রকৃতির সঙ্গে স্থূল শরীরেরই নিকট সম্বন্ধ, তাহার আধিক্যে কবিতা একটু ইন্দ্ৰিয়ানুসারিণী হইয়া পড়ে। বিদ্যাপতির দল মনুষ্যহাদয়কে বহিঃপ্রকৃতি ছাড়া করিয়া, কেবল তৎপ্রতি দৃষ্টি করেন, সুতরাং তঁহার কবিতা, ইন্দ্ৰিয়ের সংস্রব শূন্য, বিলাস শুন্য, পবিত্র হইয়া উঠে। জয়দেবের গীত, রাধাকৃষ্ণের বিলাসপুর্ণ; বিদ্যাপতির গীত, রাধাকৃষ্ণের প্রণয়পূর্ণ। জয়দেব ভোগ ; বিদ্যাপতি আকাজক্ষা ও স্মৃতি। জয়দেব সুখ, বিদ্যাপতি দুঃখ । জয়দেব বসন্ত, বিদ্যাপতি বর্ষা। জয়দেবের কবিতা, উৎফুল্লকমলজাল