বিচলিত হইয়াছে। তাঁহার প্রতিভার খ্যাতিই তাঁহার চতুষ্পার্শ্বে যে পণ্ডিত ও পণ্ডিতম্মন্য কেতাবী ভক্তের দল সৃষ্টি করিল, তাহাদের সঙ্গে তাঁহার সেই প্রতিভাই তাল রক্ষা করিতে গিয়া নিজের ইষ্টমন্ত্র ভুলিয়াছে। যে সহজাত প্রত্যক্ষ-দৃষ্টির ফলে কবিগণ পণ্ডিতের গুরুস্থানীয় হন, শরৎচন্দ্র যেন সেই গুরুর অধিকার ত্যাগ করিয়া পণ্ডিতের শিষ্যত্বকামী হইয়া উঠিলেন। তাহার ফলে তাঁহার শেষ রচনাগুলিতে জীবনের সম্বন্ধে সেই সহজ দৃষ্টি আর নাই; সমাজবিজ্ঞান এবং ব্যক্তিধর্ম্মের নানা কূটকঠিন প্রশ্নমীমাংসায় তাঁহার অনুভূতি-কল্পনা নিয়োজিত হইয়াছে—তাঁহার সম্মুখে নারীশক্তির প্রতীক সেই অন্নদাদিদির চিরন্তনী জীবনরহস্যময়ী মূর্ত্তি আর নাই, তাহার স্থানে সকল হৃদয়-রহস্যের প্রতিবাদস্বরূপিণী, কেতাবী বিদ্যার নির্য্যাসভাষিনী আধুনিক ছিন্নমস্তার রূপ বিরাজ করিতেছে। শরৎচন্দ্রের সেই লিপিকুশলতা তখনও আছে—এ সকল রচনাতেও প্রতিভার সেই স্বাক্ষর মুছিয়া যায় নাই; কিন্তু এ শরৎচন্দ্র সে শরৎচন্দ্র নয়, জীবন-সাধক তান্ত্রিক এখন ন্যায়শাস্ত্রের অধ্যাপক হইয়াছেন। যাঁহারা শরৎচন্দ্রের প্রতিভার এই নিবর্ত্তনকে পূর্ণতর বিকাশ বলিয়া মনে করেন, তাঁহাদের সহিত তর্ক করিয়া লাভ নাই; আমি শরৎচন্দ্রের সাহিত্যিক প্রতিভার সম্বন্ধে বলিতেছি—অন্যবিধ শক্তির সম্বন্ধে নয়। শরৎচন্দ্রের শ্রেষ্ঠতর সাহিত্যিক কীর্ত্তি কোন্গুলি, সে সম্বন্ধে বর্ত্তমান বা ভবিষ্যৎ কোনও রসিকসমাজেই সন্দেহের অবকাশ নাই, ও থাকিবে না। জর্জ এলিয়টের উপন্যাসগুলির সম্বন্ধে যে কথা সর্ব্ববাদিসম্মত, শরৎচন্দ্রের বইগুলির সম্বন্ধে তাহা আরও সত্য।
তথাপি শরৎচন্দ্রের সৃষ্টিশক্তি ক্রমে মন্দীভূত হইলেও শেষ পর্য্যন্ত তাঁহার রচনাশক্তি অক্ষুণ্ণ ছিল। এই দিক দিয়া দেখিলে তাঁহার