পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/১৪৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দৃষ্টি-প্রদীপ >ぐN○ তার আদরকে প্রত্যাখ্যান করতে কিছুতেই মন সরল না। আমি রাগ করে চলে গেলে ওর বুকে বড় বিধবে । ওকে একেবারেই আমরা জলে ভাসিয়ে দিয়েছি সবাই মিলে । সীতা একটাও অঙ্কযোগের কথা উচ্চারণ করলে না। কারুর বিরুদ্ধেই না। বৌদিদিকে বসে বসে একখানা লম্বা চিঠি লিখলে, আসবার সময় আমার হাতে দিয়ে বললে—আমায় পাঠাবে না কালীগঞ্জে, তুমি মিছে বলে কেন মুখ নষ্ট করবে মেজদা ! দরকার নেই। তার পর জল-ভরা হাসি-হাসি চোখে বললে—আবার কবে আসবে? ভুলে থেকে না মেজদ, শীগগির আবার এসো | পথে আসতে আসতে দুপুরের রোদে একটা গাছের ছায়ায় বসে ওর কথাই ভাবতে লাগলুম। উস্প্লাঙের মিশন-বাড়ির কথা মনে পড়ল, মেমেরা সীতাকে কত কি ছুচের কাজ, উল-বোনার কাজ শিখিয়েছিল যত্ন ক’রে । কার্ট রোডের ধারে নদীখাতের মধ্যে বসে আমি আর সীতা কত ভবিষ্যতের উজ্জল ছবি একেছি ছেলেমানুষী মনে—কোথায় কি হয়ে গেল সব ! মেয়েরাই ধরা পড়ে বেশী, জগতের দুঃখের বোঝা ওদেরই বইতে হয় বেশী ক’রে । সীতার দশা যখনই ভাবি, তখনই তাই আমার মনে হয় । মনটাতে আমার খুব কষ্ট হয়েছে সীতার স্বামীর একটা কথায়। সে আমায় লক্ষ্য করে একটা শ্লোক বললে কাল রাত্রে। তার ভাবার্থ এই—গাছে অনেক লাউ ফলে, কোন লাউয়ের খোলে কৃষ্ণনাম গাইবার একতারা হয়, কোন লাউ আবার বাবুর্চি রাধে গোমাংসের সঙ্গে । তার বলবার উদ্দেশু, আমি হচ্ছি শেষোক্ত শ্রেণীর লাউ । কেন না, আমি ব্রাহ্মণ হয়ে ব্রাহ্মণের আচার মানি নে, দেবদেবীর পূজো-আচ্চা করি নে ওর মত । ওই সব কারণে ও আমাকে অত্যন্ত কৃপার চক্ষে দেখে বুঝলাম এবং বোধ হয় নিজেকে মনে মনে হরিনামের একতারা বলেই ভাবে । ভাবুক, তাতে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু তার মতের সঙ্গে মিল না হ'লেই সে যদি আমায় ঘৃণা করে তবে আমি নিতান্ত নাচার। কোন অপরাধে আমি বাবুচির হাতে-রাধ লাউ 1 ছেলেবেলায় হিমালয়ের ওকু পাইন বনে তপস্তাস্তব্ধ কাঞ্চনজঙ্ঘার মূৰ্ত্তিতে ভগবানের অন্য রূপ দেখেছিলাম, তাই ? রাঢ়দেশের নির্জন মাঠের মধ্যে সন্ধ্যায় সেবার সেই এক অপরূপ দেবতার ছবি মনে একে গিয়েছে, তাই ? সেই অজানা নামহীন দেবতাকে উদ্দেশ ক’রে বলি—যে যা বলে বলুক, আমি আচার মানি নে, অনুষ্ঠান মানি নে, সম্প্রদায় মানি নে, কোন সাম্প্রদায়িক ধৰ্ম্মমত মানি নে, গোড়ামি মানি নে,—আমি আপনাকে মানি । আপনাকে ভালবাসি। আপনার এই বননীল দিগন্তের রূপকে ভালবাসি, বিশ্বের এই পথিক রূপকে ভালবাসি। আমার এই চোখ, এই মন জন্মজন্মাস্তরেও এই রকম রেখে দেবেন। কখনও যেন ছোট ক’রে আপনাকে দেখতে শিথি নে। আর আমার উপাসনার মন্দির এই মুক্ত আকাশের তলায় যেন চিরযুগ অটুট থাকে। এই ধৰ্ম্মই আমার ভাল । বাড়ি ফিরে দেখি বৌদিদি অত্যন্ত অসুখে পড়েছে । মহাবিপদে পড়ে গেলাম। কারও সাহায্য পাই নে, ছেলেমেয়েরা ছোট ছোট—দাদার বড় মেয়েটি আট বছরের হ’ল, সে সমস্ত কাজ করে, আমি রাধি আবার বৌদিদির সেবা-শুশ্রুষা করি। রোগিণীর ঠিকমত সেবা পুরুষের দ্বারা সম্ভব নয়, তবুও আমি আর খুকীতে মিলে যতটা পারি করি । বৌদিদির অমুখ দিন-দিন বেড়ে উঠতে লাগল। সংসারে বিশৃঙ্খলার একশেষ—বৌদিদি