পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ভূমিকা বিভূতিভূষণের প্রথম ছখানি উপন্যাস, পথের পাচালী’ ও ‘অপরাজিত', যে ধারাবাহিক রচনা অর্থাৎ বই দুটি যে একই নায়কের প্রথম ও দ্বিতীয় বয়সের কাহিনী সে কথা পাঠকদের অজানা নয়। কিন্তু তার তৃতীয় উপন্যাস "দৃষ্টি-প্রদীপ যে প্রথম বই দুটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত সে কথা হয়ত সাধারণ পাঠকের কাছে নতুন সংবাদ হতে পারে। 'দৃষ্টি-প্রদীপ যে অপরাজিতের পরে লেখা হয়েছিল তাতে সংশয় নেই, তবে সন্দেহ করি এক্ট বিষয়ে যে পথের পাচালী প্রথমে যে-ভাবে লেখা হয়েছিল তার কিছু প্রতিচ্ছায়া দৃষ্টি-প্রদীপে মাঝে মাঝে রয়ে গেছে। এখানে দেখা যাক পথের পাচালী অপরাজিতর সঙ্গে দৃষ্টি প্রদীপের মিল কোথায় ও কিসে। নায়কের নামে যে পার্থক্য আছে সে কথা বলা বাহুল্য কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলে এক রকম মিল, এমন কি স্পষ্ট মিল, খুজে পাওয়া যায়। আগেকার উপন্যাস দুটিতে নায়কের নাম “অপু” । ভাল নাম যদিচ তার অপূর্বকুমার, কিন্তু বলতে পারি তার রাশ-নাম যে অপরাজিত তাতে সন্দেহ কি। তৃতীয় উপন্যাসে নায়কের নাম “জিতু"। সম্ভবত তার ভালো নাম, লেখক ভেবেছিলেন, জিতেন্দ্র । কল্পনা করতে বাধা কি যে তার রাশ-নাম একই—অপরাজিত । অপু আর জিতু অপরাজিত নামটি যথাক্রমে পূর্ব পরাধ ভেঙে তৈরি ডাকনাম। নাম দুটির সঙ্গতি আছে। পথের পাচালী ও অপরাজিতের নায়ক অপূর্ব সুন্দর দেখতে—"কি গায়ের রং কি মুখের স্ত্র, কি মুনার স্বপ্নমাথা চোখ দুটি!" দৃষ্টি-প্রদীপের নায়ক জিতুর গায়ের রং ভালো নয়, তবে তার দাদা ও বোন ফরসা ছিল বটে। পথের পাচালীতে অপুর এক ভাই বোন, দৃষ্টি-প্রদীপে তারা দু ভাই এক বোন। মায়ের ভূমিকায় বিশেষ পরিবর্তন নেই, তবে দৃষ্টি-প্রদীপে ভূমিকাটি অধিকতর বাস্তব, ( একথা দৃষ্টিপ্রদীপের প্রায় সকলের ভূমিকা সম্বন্ধেই বলা চলে । ) জিতুর পিতা খুব স্নেহপরায়ণ নন। তিনি ভালমানুষ তবে মদ্যাসক্ত। “বাবা অত্যন্ত মদ খান—এবং যেদিন খুব বেশী করে খেয়ে আসেন, সেদিন আমাদের বাংলো ছেড়ে পালাতে হয় ।” তার পরিণামও অনুরূপ বাস্তব তবে অত্যন্ত নিষ্ঠুর। পথের পাচালীর পোশাকে তিনি অকৃতার্থ—পাড়াগায়ে ভালোমানুষের রোমাটিক আদর্শ এবং ঝাপসা। দৃষ্টি-প্রদীপের জ্যাঠাইমা অত্যন্ত নিষ্ঠুর চরিত্র। অপরাজিতয় তার প্রকৃতি বদল হয় নি তবে উগ্রতার বাজ কমে স্বভাবসঙ্গত হয়েছে। দৃষ্টি-প্রদীপে নায়কের অল্পবয়স সুন্দরী মেয়ের উপর দৃষ্টিপাত অনেক কম, তার ফলে তেমন ভূমিকার সংখ্যাও বেশি নয়। তবে একটি চরিত্র দুটি উপন্যাসেই রয়েছে। অপরাজিতয় যে পটেশ্বরী দৃষ্টি-প্রদীপে সেইই হিরন্ময়ী। তবে হিরন্ময়ীর সঙ্গে শেষ পর্যন্ত জিতুর বিয়ে ঘটেছে। এখন "দৃষ্টি-প্রদীপ নামকরণের সার্থকতা বিচার করি। তিনটি উপন্যাস যিনি একসঙ্গে পড়বেন তিনি বুঝবেন যে পথের পাচালী’ নামটি তৃতীয় বইটির পক্ষে বোধ করি সর্বাধিক সঙ্গত হত। প্রথম বইটিতে পথ চলার ব্যাপারের চেয়ে পথের ডাকেরই জোর বেশী। অপুর পাচালি'র সেখানে তো সবে শুরু। অন্যদিকে দৃষ্টি-প্রদীপ নামটিতে অসঙ্গতি নেই। অপু ভাবুক ছেলে কিন্তু তার চোখের ঘোর খুব বেশি। আশেপাশে যা কিছু তার চোখে পড়ে~~গাছপাল, নদীখাল, রোদ-মেঘ-সবই তার আঁখি মজার, তার মন টানে। তার অজানতে মনে সর্বদা যেন গুঞ্জরিত ছিল রবীন্দ্রনাথের গানের এই ছত্রটির ভাব—