একাদশ পরিচ্ছেদ
সেও এক কৃষ্ণপক্ষের গভীর অন্ধকার রাত্রি। মাঝে-মাঝে বৃষ্টি পড়চে আবার থেমে যাচ্চে, অথচ গুমট কাটেনি। আমার ঘরটার উত্তরদিকে একটা মাত্র কাঠের গরাদে দেওয়া জানলা, জানলার সামনাসামনি দরজা। পশ্চিমদিকের দেওয়ালে জানলা নেই—একটা ঘুল-ঘুলি আছে মাত্র।
রাত প্রায় একটা কি তার বেশি। আমার ঘুম আসে নি, তবে সামান্য একটু তন্দ্রার ভাব এসেচে।
হঠাৎ বাইরে ঘুলঘুলির ঠিক নীচেই যেন কার পায়ের শব্দ শোনা গেল! গরু কি ছাগলের পায়ের শব্দ হওয়া বিচিত্র নয়—বিশেষ গ্রাহ্য করলাম না।
তারপর শব্দটা সেদিক থেকে আমার শিয়রের জানলার কাছে এসে থামলো। তখনও আমি ভাবচি, ওটা গরুর পায়ের শব্দ। এমন সময় আমার বিস্মিত-দৃষ্টির সামনে দিয়ে অস্পষ্ট অন্ধকারের মধ্যে কার একটা সুদীর্ঘ হাত একেবারে আমার বুকের কাছে—ঠিক বুকের ওপর পৌঁছলো—হাতে ধারালো একখানা সোজা-ছোরা, অন্ধকারেও যেন ঝক্ঝক্ করচে!
ততক্ষণে আমার বিস্ময়ের প্রথম মুহূর্ত কেটে গিয়েচে।
আমি তাড়াতাড়ি পাশমোড়া দিয়ে ছোরা-সমেত হাতখানা ধরতে গিয়ে মুহূর্তের জন্য একটা বাঁশের লাঠিকে চেপে ধরলাম।
পরক্ষণেই কে এক জোর ঝট্কায় লাঠিখানা আমার হাত থেকে ছিনিয়ে নিলে। সঙ্গে-সঙ্গে ছোরার তীক্ষ্ণ অগ্রভাগের আঘাতে আমার হাতের কব্জি ও বুকের খানিকটা চিরে রক্তারক্তি হয়ে গেল।
তাড়াতাড়ি উঠে টর্চ জ্বেলে দেখি, বিছানা রক্তে মাখামাখি হয়ে গিয়েচে। তখুনি নেকড়া ছিঁড়ে হাতে জলপটি বেঁধে লণ্ঠন জ্বাললাম।
লাঠির অগ্রভাগে তীক্ষ্ণাগ্র ছোরা বাঁধা ছিল—আমার বুক লক্ষ্য ক’রে ঠিক কুড়ুলের কোপের ধরনে লাঠি উঁচিয়ে কোপ মারলেই ছোরা পিঠের ওদিক দিকে ফুঁড়ে বেরুতো। তারপর বাঁধন আল্গা ক’রে ছোরাখানা আমার বিছানার পাশে কিংবা আমার ওপর ফেলে রাখলেই আমি যে আত্মহত্যা করেচি, এ-কথা বিশেষজ্ঞ ভিন্ন অন্য লোককে ভুল করে বোঝানো চলতো।
আমি নিরস্ত্র ছিলাম না—মিঃ সোমের ছাত্র আমি। আমার বালিশের তলায় ছ’ নলা অটোমেটিক ওয়েব্লি লুকোনো। সেটা হাতে ক’রে তখুনি বাইরে এসে টর্চ ধরে ঘরের সর্ব্বত্র খুঁজলাম—জানালার কাছে জুতো-সুদ্ধ টাট্কা পায়ের দাগ!
ভালো ক’রে টর্চ ফেলে দেখলাম।
কি জুতো?…রবার-সোল, না, চামড়া?…অন্ধকারে ভালো বোঝা গেল না।