পাতা:বিভূতি রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড).djvu/১৮১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আরণ্যক ১৬৫ লাগিল। যোগাযোগ হইয়াছিল বোধ হয় অদ্ভূত—এতদিন পরে দেশে প্রত্যাবৰ্ত্তন, সরস্বতী হ্রদের জ্যোৎস্নালোকিত-বারিরাশি ও বনফুলের শোভা, বন্ত শেফালীর জ্যোৎস্না-মাখানে সুবাস, শাস্ত স্তব্ধতা—ভাল ঘোড়ার চমৎকার কোণাকুণি ক্যান্টার চাল, হু হু হাওয়া—সব মিলিয়া স্বপ্ন ! স্বপ্ন ! আনন্দের ঘন নেশা ! আমি যেন যৌবনোন্মত্ত তরুণ দেবতা, বাধাবন্ধহীন, মুক্ত গতিতে সময়ের সীমা পার হইয়া চলিয়াছি—এই চলাই যেন আমার অদৃষ্টের জয়লিপি, আমার সৌভাগ্য, আমার প্রতি কোন স্বপ্রসন্ন দেবতার আশীৰ্ব্বাদ ! হয়তো আর ফিরিব না—দেশে ফিরিয়া মরিয়াও ত যাইতে পারি। বিদায় সরস্বতী-কুঞ্জী, বিদায়—তীরতরু-সারি, বিদায়—জ্যোৎস্নালোকিত মুক্ত বনানী। কলিকাতার কোলাহলমুখর রাজপথে দাড়াইয়া তোমার কথা মনে পড়িবে, বিস্তৃত জীবনদিনের বীণার অনতিস্পষ্ট ঝঙ্কারের মত—মনে পড়িবে যুগলপ্রসাদের আন গাছগুলির কথা, জলের ধারে স্পাইডার লিলি ও পদ্মের বন, তোমার বনের নিবিড় ডালপালার মধ্যে স্তব্ধ মধ্যাহ্নে ঘুঘুর ডাক, অস্তমেঘের ছায়ায় রাঙা ময়নার্কাটার গুড়ি ও ডাল, তোমার নীল জলে উপরকার নীল আকাশে উড়ন্ত সিল্লি ও লাল হাসের সারি—জলের ধারের নরম কাদার উপরে হরিণ-শিশুর পদচিহ্ন • নির্জনতা, সুগভীর নির্জনতা । বিদায়, সরস্বতী কুণ্ডী । ফিরিবার পথে দেখি সরস্বতী হ্রদের বন হইতে বাহির হইয়া মাইলথানেক দূরে একটা জায়গায় বন কাটিয়া একখানা ঘর বসাইয়৷ মানুষ বাস করিতেছে—এই জায়গাটার নাম হইয়াছে নয়। লবটুলিয়া—যেমন নিউ সাউথ ওয়েলস্ বা নিউ ইয়র্ক। নূতন গৃহস্থ পরিবার আসিয়া বনের ডালপালা কাটিয়া (নিকটে বড় বন নাই, মুতরাং সরস্বতীর তীরবর্তী বন হইতেই আমদানী নিশ্চয়ই ) ঘাসের ছাওয়া তিন-চারখানা নীচু নীচু খুপড়ি বাধিয়াছে। তারই নীচে এখনও পর্য্যন্ত ভিজা দু Tার উপর একটা নারিকেল কিংবা কড়া তেলের গলা-ভাঙা বোতল, একটি উলঙ্গ হামাগুড়িরত কৃষ্ণকায় শিশু, কয়েকটি সিহোড়া গাছের সরু ডালে বোন। ঝুড়ি, একটি মোটা রূপার অনন্ত পরা যক্ষের মত কালো আঁটপাট গডনের বউ, খানকয়েক পিতলের লোটা ও থালা ও কয়েকখানা দা, খোস্তা, কোদাল । ইহাই লইয়া ইহার প্রায় সবাই সংসার করে। শুধু নিউ লবটুলিয়া কেন, ইসমাইলপুর ও নাঢ় বইহারের সর্বত্রই এইরূপ। কোথা হইতে উঠিয়া আসিয়াছে তাই ভাবি ; ভদ্রাসন নাই, পৈতৃক ভিটা-নাই, গ্রামের মায়া নাই, প্রতিবেশীর স্নেহমমতা নাই—আজ--ইসমাইলপুরের বনে, কাল মুঙ্গেরের দিয়ার চরে, পরশু জয়ন্তী পাহাড়ের নীচে তরাই ভূমিতে—সৰ্ব্বত্রই ইহাদের গতি, সৰ্ব্বত্রই ইহাদের ঘর। পরিচিত কণ্ঠের আওয়াজ পাইয়া দেখি রাজু পাড়ে এই ধরনের একটি গৃহস্থ-বাড়ীতে বসিয়া ধৰ্ম্মতত্ত্ব আলোচনা করিতেছে। উহাকে দেখিয়া ঘোড হইতে নামিলাম। আমায় সবাই মিলিয়া খাতির করিয়া বসাইল। রাজুকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলাম সে এখানে কবিরাজি করিতে আসিয়াছিল। ভিজিট পাইয়াছে চারিকাঠা যব এবং নগদ আট পয়সা। ইহাতেই সে মহা খুশী হইয়া ইহাদের সহিত আসর জমাইয়। দার্শনিক তত্ত্ব আলোচনা জুড়িয়া দিয়াছে। আমায় বলিল—বস্কন, একটা কথার মীমাংসা করে দিন ত বাবুজী! আচ্ছ, পৃথিবীর কি