পাতা:বিভূতি রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড).djvu/৩২৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৩১২ বিভূতি-রচনাবলী এখন বুঝি কলকাতায় আছেন ? বৃদ্ধের চোখে জল এল প্রশংসা শুনে। বললে, আর বাবু মশায়, আমাদের দিন ফুরিয়েছে। এই দেখুন, আজ তিনটি বছর চাকুরি নেই। কোন দলে নিতে চায় না। বলে, আপনার বয়স হয়েছে হাজরা মশাই, এ বয়সে আর আপনার চাকরি করা পোষাবে না, আসল কথা আমাদের আর চায় না। ভালো জিনিসের দিন আর নেই, বাবু মশায়। এখানকার কালে সব হয়েছে মেকি । মেকির অাদর এখন খাট জিনিসের চেয়ে বেশি । আমার গুরু ছিলেন বৌ-মাস্টারের দলের ভৃগু সরকার, আজকালকার কোন ব্যাটা অ্যাক্টার ভৃগু সরকারের পায়ের ধুলোর যুগি আছে ? 'রাই উন্মাদিনী’ পালায় আয়ানঘোষের পাটে যে একবার ভৃগু সরকারকে দেথেচে— আরও বার কয়েক প্রশংসা করে এই ভগ্নহৃদয় বৃদ্ধ নটকে শাস্ত করলুম। জিজ্ঞাসা ক’রে ক্রমশ জানলুম এই মশলার দোকানই বৃদ্ধের বর্তমান আশ্রয় স্থল। কাছেই গলির মধ্যে কোন ঠাকুরবাড়ীতে এক বেলা খেতে দেয়, রাত্রে এই দোকানটাতে শুয়ে থাকে। দোকানের মালিক বোধ হয় ওর জানাশোনা । কাৰ্য্যোপলক্ষ্যে গলিট দিয়ে প্রতিদিনই যাতায়াত করি, আর ফিরবার সময়ে যদু হাজরার সঙ্গে একটু গল্প-গুজব করি। একদিন বৃদ্ধ বললে—বাবু মশাই, একটা কথা বলব ? একদিন একটু মাংস খাওয়াবেন ? কতকাল খাইনি। একটা ভালো রেস্টোরেন্টে তাকে নিয়ে গিয়ে খাওয়ালুম। ওর খাওয়ার ভঙ্গি দেখে মনে হ’ল, বৃদ্ধ কতদিন ভালো জিনিস খেতে পায়নি। তারপর দুজনে একটা পর্কে গিয়ে বসলুম। রাত তখন ন’টা বেজে গিয়েছে। শীতকাল, অনেকে পার্ক থেকে চলে গিয়েছে। একটা বেঞ্চে বসে বৃদ্ধ নিজের সম্বন্ধে কত কথাই বললে। কোন জমিদার কবে তাকে আদর করে ডেকে নিজের হাতে সোনার মেডেল পরিয়ে দিয়েছিলেন, তার অভিনয় দেখে কবে কোন মেয়ে তার প্রেমে পডেছিল, হাতীবাধার রাজা নিজের গায়ের শাল খুলে ওর গায়ে জডিয়ে দিয়েছিলেন। বলতে বলতে মাঝে মাঝে যেন ও অশ্বমনস্ক হয়ে পড়েচে । পচিশ বৎসর আগের কোন তরুণী প্রেমিকার হাসিমাখা চাহনি ওর আবেশ-মধুর যৌবনদিনগুলির উপর স্পর্শ রেখে গিয়েচে-কে জানে সেই সব দিন, সেই সব বিস্মৃতপ্রায় মুখ ও মনে আনবার চেষ্টা করছিল কিনা। আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললুম-শিথিধ্বজ আর মধুচ্ছদার সেই অভিনয় আমার বড় ভালো লাগে, সেই যখন রাজা বললেন, “তোমরা প্রেমিক প্রেমিকার মত হাতধরাধরি করে চলে যাও—সেই জায়গাট এখনও ভুলিনি। বৃদ্ধ নট সোজা হয়ে বসল। তার চোথে যৌবন-কালের সেই হারানো দীপ্তি যেন ফিরে এল। বললে—৪:, সে কত কালের কথা যে ! ও পালা গেয়েছি প্রসন্ন নিয়োগীর দলে থাকতে । দেখবেন—করে দেখাব ? আমি উৎসাহের সঙ্গে বললুম—মনে আছে আপনার ? দেখান না ? ভাগ্যে পার্কে তখন বিশেষ কেউ ছিল না। বৃদ্ধ উঠে দাডাল—আমি হলুম মধুচ্ছদ ।