লোহারডাগ অধিত্যক শাখা লইয়া জেলার উত্তর-পশ্চিমাংশে যে উপবিভাগ হইয়াছে, তাহাই পালামে নামে পরিচিত। অবশিষ্ট সমগ্র জেলাভাগ জনমানবপরিশূন্ত উন্নত পৰ্ব্বতশিখর অথবা ইতস্তত: বিক্ষিপ্ত গণ্ডশৈলে পূর্ণ। এই সকল শৈলমালা প্রধানতঃ পূৰ্ব্বপশ্চিমে বিস্তৃত, কিন্তু স্থানবিশেষে তাহারও বৈলক্ষণ্য দৃষ্ট হয়। সমুদ্রপৃষ্ঠ হইতে এই পৰ্ব্বতময় প্রদেশ সৰ্ব্বত্রই প্রায় ১২•• ফিটু উচ্চ, স্থল বিশেষে শৈলোচ্চ শিখরভূমি ৩••• ফিটেরও অধিক উৰ্দ্ধ দৃষ্ট হয়। রাচী নগরের পশ্চিমস্থ সারুশৃঙ্গ ৩৬১৫ এবং উত্তরদিকৃস্থ ববোগাই বা মরঙ্গবন্ধচুড়া ৩৪৪৪ ফিটু উচ্চ। • প্রকৃত ছোট নাগপুর উপবিভাগ অপেক্ষ, পালামে বিভাগে অধিকতর পর্বতমালা দৃষ্ট হয়। এখানকার ভূমিভাগ এতই ক্ৰমোচ্চনিম্ন যে, কোথাও সমতল ক্ষেত্রাদি দৃষ্টিগোচর হয় না। উত্তর কোয়েল ও অমানং নদীদ্বয় প্রবাহিত-উপত্যক প্রদেশ ভিন্ন অন্তর ধান্তাদি উৎপন্ন হয় না। এই জেলার সুবর্ণরেখা এবং উত্তর ও দক্ষিণ কোয়েল নদী প্রধান । তদ্ভিন্ন কাঞ্চী, কর্করী, অমানৎ, উরঙ্গা, কারু ও দেও নামক শাখা কয়ট উপরোক্ত নদীত্রয়ের কলেবর পুষ্ট করিয়া এই জেলার মধ্যে প্রবাহিত আছে। ছোট নাগপুরের উক্ত পৰ্ব্বতদ্বয় ব্যতীত পালামে বিভাগে বুলবুল (৩৩২৯ ফিট, ), বুরী (৩.৭৮ ফিট) ও কোতাম ( ২৭৯১ ফিট) নামে আরও তিনটী উচ্চ শৈল আছে। এই সকল পৰ্ব্বতের নিম্নদেশ বনকুন্দে ও পলাশবনে পূর্ণ। বরাসোঁদ, পালামে প্রভৃতি বনভাগে শাল, মহুয়া, জামুন, করপ্পা প্রভৃতি বৃক্ষ উৎপন্ন হয়। শালকাঠ চেরাই হইয়া নদীবক্ষে ভাসাইয়৷ নানা স্থানে বিক্রয়ার্থ প্রেরিত হইয়া থাকে । বনভাগে কাষ্ঠ ব্যতীত মহুয়াফুল, জাম ও তুথফল, করপ্লবীজ, লাক্ষা, তসর (গুট ), রজন, মধু, গদ ও আরাক্কট প্রভৃতি জন্মে। সেই বনপ্রাস্তবাসী আদিম অধিবাসিবর্গ ঐ সকল দ্রব্য সংগ্ৰহ করিয়া নিকটবৰ্ত্তী হাটে বিক্রয় করিতে আনে । খনিজ পদার্থের মধ্যে এখানে লৌহ ও চুণা পাথর প্রধান। পলাশে বিভাগে তাম্র এবং সিংহভূম সীমান্তস্থিত সোণাপেট উপত্যকায় নদীর বালুকাকণা বিধৌত করিয়া স্বর্ণ আহৃত হইয়া থাকে । কোয়েল হইতে অমানং নদীর উপত্যকার কতকাংশ পর্যন্ত এবং প্রায় পূৰ্ব্বপশ্চিমে ৫০ মাইল বিস্তৃত আনুমানিক ২০০ বর্গমাইল স্থানে কয়লার খাদ আছে । উস্থা ডালটনগঞ্জ কয়লার খনি নামে প্রসিদ্ধ। এতদ্ভিন্ন কর্ণপুর কয়লার খনি দক্ষিণে তোরী পরগণা পর্যন্ত বিস্তৃত রহিয়াছে। এখানকার বনবিভাগে ব্যাঘ, চিত, নেকড়ে, ভল্লক, বনবরাহ, [ ৩২৬ ] লোহারডাগা হায়না, বিভিন্ন জাতীয় হরিণ ও নীলগাই পাওয়া যায়। অপরাপর ক্ষুদ্র জন্তু এবং শিকারযোগ্য পারাবত, হংসাদি পক্ষীরও অভাব নাই। নদী ও পাৰ্ব্বত্য খাদ সমুছে নানাজাতীয় রুই, কাতলা প্রভৃতি মৎস্ত জন্মে, তন্মধ্যে মহাশীর মৎস্তু বিশেষ উল্লেখযোগ্য । বাঙ্গালার সীমাভুক্ত হইলেও এই স্থানের কোন প্রাচীন ইতিহাস পাওয়া যায় না। অধিক সম্ভব, পূৰ্ব্বে এই স্বান পৰ্ব্বতময় ও গভীর জঙ্গলে আবৃত ছিল। উহার প্রাচীন নাম “ঝারখগু” আজিও সেই শ্বাপদসঙ্কুল বিজন অরণ্যপ্রদেশের পরিচয় দিতেছে। সেই বিজন বনবাসে বাঙ্গালার আদিম অধিবাসী মুওাগণ ও পরে ওরাওনগণ বহুপূৰ্ব্বকাল হইতে বাস করিতেছে । এই দুইটী জাতি একস্থানে বহুকাল আবদ্ধ থাকিলেও পরস্পরে বিবাহাদি যৌবনসম্বন্ধে আবদ্ধ হয় নাই। পরস্পরে জাতীয় পার্থক্য রক্ষাপূর্বক আজিও স্ব স্ব জাতীয় ধৰ্ম্ম ও কুলপ্রথা পালন করিতেছে ; কিন্তু ইহাদের উভয়েরই শাসননীতি প্রায় এক প্রকার। গ্রাম্য মণ্ডলের প্রবর্তিত “পর্হী” প্রথায় ইহার এক একটী গ্রামকর্তা বা সর্দারের অধীনে থাকিয় তাহারই আদেশ পালনপুৰ্ব্বক রাজনিয়ম রক্ষা করিতে বাধ্য। বাস্তবিক পক্ষে বহু পূৰ্ব্বকাল হইতে এই বনান্তরাল প্রদেশে পাৰ্ব্বত্য অনার্য্যগণ স্বাধীন ভাবে ও সানন্দচিত্তে স্বেচ্ছাবিহারী হইয়া বসবাস করিয়া আসিতেছিল। তাহাদের এই নৈসর্গিক শাস্তিমুখ নাশ করিয়া কোন রাজাই তাহাদিগকে শাসনগৃঙ্খলায় আবদ্ধ করিতে চান নাই। তাহারা পার্শ্ববৰ্ত্তী রাজন্তগণকে রাজমান্ত দান করিতে শিখিলেও, সভ্যতার কুটিল সামাজিকতায় পদার্পণ করিতে চাহে নাই। তাহারা আনন্দন্থদয়ে বনবিহঙ্গমের ন্যায় ইতস্ততঃ বিচরণ করিয়া বেড়াইত এবং কুটর বঁাধিয়া একত্র এক একটী গ্রামে দলবদ্ধ হইয়া বাস করিত। গ্রামস্থ এক এক জন দলপতি সমগ্র গ্রামবাসীর নেতৃত্ব গ্রহণ করিত। তাহার আদেশ গ্রামবাসীর রাজাজ্ঞা বলিয়া পালন করিত, এমন কি, ইহারা আপন আপন গ্রাম্য মণ্ডলের আদেশ বা পরামর্শানুসারে দূরস্থ কোন শত্রুর সহিত যুদ্ধ করিতে কাতর হইত না । তীর ধনুক লইয়া ইহার যুদ্ধ করিত। অনাৰ্য্য গ্রাম্য দলপতিগণ কালে সভ্যতার সংমিশ্রণে সামস্তরাজরূপে পরিগণিত হইয়াছে । ইহাদের অধীনে ক্রমশঃ অনেক গ্রাম্য দলপতি সন্মিলিত হইয়া এক একটী রাজশক্তি সংগঠন করিয়াছে। ঐ সকল গ্রাম্য দলপতির মধ্যে যাহারা দলবল লইয়া পৰ্ব্বতকক্ষস্থ ঘাটী বা গমনপথ শক্রর আগমন হইতে রক্ষা করিত, তাহারা ঘাটবাল বা সর্দার নামে পরিচিত ।
পাতা:বিশ্বকোষ ঊনবিংশ খণ্ড.djvu/৩২৬
অবয়ব