পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/১৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিষাদ-সিন্ধু

পুত্তলী, মশুকের অমূল্য মণি, হৃদয়ভাণ্ডারের মহামূল্য রত্ন, জীবনের জীবনীশক্তি, আশা-তরু অসময়ে মঞ্জুরিত, আশা-মুকুল অসময়ে মুকুলিত, আশা-কুসুম অসময়ে প্রস্ফুটিত। বাছা, সদা-সর্ব্বদাই তােমার মলিন মুখ ও বিমর্ষ ভাব দেখিয়া আমি একেবারে হতাশ হইয়াছি, জীবনের আশা পরিত্যাগ করিয়াছি। ঈশ্বর তােমার মঙ্গল করুন, মনের কথা অকপটে আমার নিকট প্রকাশ কর। আমি পিতা হইয়া মনের বেদনায় আজ তোমার হস্তধারণ করিয়া বলিতেছি, সকল কথা মন খুলিয়া আমার নিকট কি জন্য প্রকাশ কর না?” মাবিয়া নির্জ্জনে আগ্রহসহকারে এজিদকে এই সকল কথা জিজ্ঞাসা করিলেন।

 এজিদ্ দীর্ঘ নিঃশ্বাস পরিত্যাগ-পূর্ব্বক বলিতে অগ্রসর হইয়াও কোন কথা বলিতে পারিলেন না; কণ্ঠরােধ হইয়া জিহ্বায় জড়তা আসিল। মায়ায় আসক্তির এমনি শক্তি যে, পিতার নিকট মনােভাব প্রকাশ করিবার অবসর প্রাপ্ত হইয়াও মনােভাব প্রকাশ করিতে পারিলেন না। সাধ্যাতীত চেষ্টা করিয়াও মুক্ত হৃদয়ে প্রকৃত মনের কথা পিতাকে বুঝাইতে পারিলেন না। যদিও বহুকষ্টে “জয়” শব্দটি উচ্চারণ করিলেন, কিন্তু সে শব্দ মাবিয়ার কর্ণগােচর হইল না। কথা যেন নয়নজলেই ভাসিয়া গেল, শব্দটি কেবল জলমাত্রই সার হইল। গণ্ডস্থল হইতে বক্ষঃস্থল পর্য্যন্ত বিষাদ-বারিতে সিক্ত হইতে লাগিল। সেই বিষাদ-বারি-প্রবাহ দর্শন করিয়া অনুতপ্ত মাবিয়া আরও অধিকতর দুঃখানলে দগ্ধীভূত হইতে লাগিলেন। জলে অগ্নি নির্ব্বাপিত হয়, কিন্তু প্রেমাগ্নি অন্তরে প্রজ্জ্বলিত হইয়া প্রথমে নয়ন দুইটির আশ্রয়ে বাষ্প সৃষ্টি করে, পরিণামে জলে পরিণত হইয়া স্রোতে বহিতে থাকে। সে জলে হয়ত বাহ্যবহ্নি সহজে নির্ব্বাপিত হইতে পারে; কিন্তু মনের আগুন দ্বিগুণ, চতুর্গুণ, শতগুণ জ্বলিয়া উঠে। এজিদ্ রাজ্যের প্রয়াসী নহেন, সৈন্যসামন্ত এবং রাজমুকুটের প্রত্যাশী নহেন, রাজসিংহাসনের আকাঙ্ক্ষীও নহেন। তিনি যে রত্নের প্রয়াসী, তিনি যে মহামূল্য ধনের প্রত্যাশী, তাহা তাঁহার পিতার মনের অগােচর, বুদ্ধির অগােচর। পুত্রের ঈদৃশী অবস্থা দেখিয়া মাবিয়া যারপর নাই দুঃখিত ও চিন্তিত হইলেন। শেষে অশ্রুসম্বরণে অক্ষম হইয়া বাষ্পাকুল লােচনে পুনর্ব্বার বলিতে লাগিলেন, “এজিদ্! তােমার মনের কথা খুলিয়া