পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/২৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১১
মহরম পর্ব্ব-দ্বিতীয় প্রবাহ

না। আপনি বোধ হয় স্থির করিয়াছেন যে, যাহাদের অনেক দাস-দাসী আছে, মণিমুক্তার অলঙ্কার আছে, বহুমূল্য বস্ত্রাদি আছে, তাহারাই জগতে সুখী—তাহা মনে করিবেন না; মনের সুখই যথার্থ সুখ।”

 আবদুল জব্বার বলিলেন, “ও কোন কথাই নহে। টাকা থাকিলে সুখের অভাব কি? আমি যদি এজিদের ন্যায় ঐশ্বর্য্যশালী হইতাম, তোমাকে কত সুখে রাখিতাম, তাহা আমি জানি আর আমার মনই জানে। ঈশ্বর টাকা দেন নাই, কি করিব, মনের সাধ মনেই রহিয়া গেল।”

 গম্ভীর বদনে জয়নাব কহিলেন, “ও কথা বলিবেন না। শাহজাদা এজিদের ন্যায় আপনি ক্ষমতাবান বা ধনবান হইলে আমার ন্যায় কুশ্রী স্ত্রীর প্রতি আপনার ভালবাসা জন্মিত না। আপনারই নয়ন আমাকে দেখিয়া ঘৃণা করিত। ঈশ্বরের সৃষ্টি অতি বিচিত্র। কাহাকেও তিনি সীমাবিশিষ্ট করিয়া রূপবতী করেন নাই। উচ্চাসনে বসিলে আপনার মন সেইরূপ উচ্চরূপেই মোহিত হইত। অবস্থার পরিবর্ত্তনে মানুষের মনের পরীক্ষা হয়।”

 “অবস্থার পরিবর্ত্তন হইলেই কি প্রণয়, মায়া, মমতা, ভদ্রতা ও সুহৃদ ভাবের পরিবর্ত্তন হয়?”

 “হীন অবস্থার পরিবর্ত্তনে অবশ্য কিছু পরিবর্ত্তন হয়,—কিছু কেন? প্রায়ই পরিবর্ত্তন হইয়া থাকে। চারিদিকে চাহিলেই অনেক দেখিতে পাইবেন। যাহারা ধনপিপাসু, অর্থকেই যাহারা ইহকাল-পরকালের সুখসাধন মনে করে, অর্থলোভে অতি জঘন্য কার্য্য করিতে তাহারা একটুও চিন্তা করে না, অতি আদরের ও যত্নের ভালবাসা জিনিসটিও অর্থলোভে বিসর্জ্জন দিতে কিছুমাত্র অপেক্ষা করে না।

 কিঞ্চিৎ ক্ষুণ্ণ হইয়া আবদুল জব্বার কহিলেন, “এ কথাটা এক প্রকার আমাতেই বর্ত্তিল। তুমি যাহাই বল, জগতের সমুদয় অর্থ, সমুদয় ঐশ্বর্য্য একত্র করিয়া আমার সম্মুখে রাখিলেও আমি আমার ভালবাসাকে পরিত্যাগ করিতে পারিব না। সকলেরই মুল্য আছে, ভালবাসার মূল্য নাই। যখন মূল্য নাই, তখন আর তাহার সঙ্গে অন্য বস্তুর তুলনা কি, কথাই বা কি?”

 আবদুল জব্বারের আহার শেষ হইল। রীতিমত হস্তমুখাদি প্রক্ষালন