পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/৪৬৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিষাদ-সিন্ধু
৪৪৮

বিচারে বৃদ্ধ বয়সে লৌহ-নিগড়ে তাঁহাকে আবদ্ধ হইতে হইল! শুনুন, মন্ত্রিপ্রবর মৃদু মৃদু স্বরে কি কথা বলিতেছেন,—

 রাজার অভাব হইলে রাজা পাওয়া যায়, রাষ্ট্রবিপ্লব ঘটিলে তাহারও শাস্তি হয়, রাজ্যমধ্যে ঘোর বিদ্রোহানল প্রজ্জ্বলিত হইলেও যথাসময়ে অবশ্যই তাহার নির্ব্বাণ হয়, উপযুক্ত দাবী বুঝাইয়া দিলে সে দুর্দ্দমনীয় তেজও একেবারে বিলীন হইয়া উড়িয়া যায়। মহামারী, জলপ্লাবন ইত্যাদি দৈবদুর্বিপাকে রাজ্যধ্বংসের উপক্রম বোধ হইলেও নিরাশ-সাগরে ভাসিতে হয় না—আশা থাকে। রাজা মজ্জা-দোষে, কি মন্ত্রণার অভাবে রাজ্যশাসনে অকৃতকার্য্য হইলেও আশা থাকে। মূর্খ রাজার প্রিয় পাত্র হইবার আশায়, মন্ত্রণাদাতাগণ অবিচার, অত্যাচার নিবারণে উপদেশ না দিয়া অহরহঃ তোষামোদের ডালি মাথায় করিয়া প্রতিটি রাজাজ্ঞা অনুমোদন করাতেই যদি রাজায় প্রায় মনান্তর ঘটে, তাহাতেও আশা আছে—সে ক্ষেত্রেও আশা থাকে। কিন্তু স্বাধীনতা-ধনে একবার বঞ্চিত হইলে সহজে সে মহামণির মুখ আর দেখা যায় না। বহু আয়াসেও সে মহামুল্য রত্ন আর হস্তগত হয় না। স্বাধীনতা-সূর্য্য একবার অস্তমিত হইলে তাহার পুনরুদয় হওয়া বড়ই ভাগ্যের কথা।

 “রাজা আর রাজ্য, এই দুইটি পৃথক কথা—পৃথক ভাব—পৃথক সম্বন্ধ। রাজা নিজ বুদ্ধি-দোষে অপদস্থ হউন, সদ্‌যুক্তি, সুমন্ত্রণা অবহেলা করিয়া পর-পদতলে দলিত হউন, স্বেচ্ছাচারিত্ব দোষে অধঃপাতে যাউন, তাহাতে রাজ্যের কি? কার্য্যানুরূপ ফল, পাপানুযায়ী শাস্তি। স্বেচ্ছাচারী, সুমন্ত্রণা-বিদ্বেষী, নীতি-বর্জ্জিত, উচিত কথায় বিরক্ত,—এমন রাজার রাজ্যপাট যত সত্বর ধ্বংস হয়, ততই মঙ্গল, ততই রাজ্যের শনিক্ষয় ও ভবিষ্যৎ মঙ্গলের আশা। দামেস্ক-রাজ্যের আর মঙ্গল নাই। বিনা কারণে, প্রেমের কূহকে, পিরিতের দায়ে, প্রণয়-বাসনায়, পরিণয়-ইচ্ছায়, যদি এই রাজ্য যথার্থই পরকরতলস্থ হয়, পরপদভরে দলিত হয়, আমাদের স্বাধীনতা লোপ হয়, তবে সে দুঃখের আর সীমা থাকিবে না, সে মনঃকষ্টের আর ইতি হইবে না। রাজা প্রজা-রক্ষক, বিচারক, প্রজাপালক এবং