পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/৫০৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিষাদ-সিন্ধু
৪৮২

জলে ভাসিতে লাগিল। মহা মহা বীরসকল, এক বিন্দু জলের জন্য লালায়িত হইয়া শত্রুহস্তে অকাতরে প্রাণ সমর্পণ করিল। কত বালক বালিকা শুষ্ককণ্ঠ হইয়া ছট্‌ফট্‌ করিতে করিতে পিতার বক্ষে মাতায় ক্রোড়ে দেহত্যাগ করিয়া অনন্তধামে চলিয়া গেল। কাসেম-সখিনার কথা মনে হইলে এখনও অঙ্গ শিহরিয়া উঠে। শোকসিন্ধুমধ্যে বিবাহ!—কি নিদারুণ কথা! কাসেম-সখিনার বিবাহের কথা মনে পড়িলে প্রাণ ফাটিয়া যায়! দুর্দ্দি‌নের শেষ ঘটনায়, যাহা ঘটিবার ঘটিয়া গেল। বিশ্বপতি বিশ্বেশ্বরের মহিমা প্রকাশ হইল। সে অনন্ত ইচ্ছাময়ের ইচ্ছা পূর্ণ করিতে কাহারও বাধা দিবার ক্ষমতা যে নাই, প্রভু হোসেন তাহারই দৃষ্টান্ত দেখাইয়া সীমারের খপ্পরে দেহত্যাগ করিলেন। ‘হায় হোসেন!’ ‘হায় হোসেন!’ রবে প্রকৃতির বক্ষ ফাটিতে লাগিল। আমরা তখনই বন্দিনী! নূরনবী মোহাম্মদের পরিজনগণ তখনই বন্দিনী! দামেস্কে আসিলাম। আর রক্ষা নাই। এজিদ-হস্ত হইতে আর নিস্তার নাই। ডুবিলাম, আর উপায় নাই। নিরাশ্রয়ার আশ্রয়ই ঈশ্বর। আশা-ভরসা যাহা যাহা সম্বল ছিল, ক্রমে হৃদয় হইতে সে সকল সরিয়া এক মহাবলের সঞ্চার হইল; এজিদ্‌-নামে আর কোন ভয়ই রহিল না। এই ছুরিকা হস্তে করিতেই মন যেন ডাকিয়া বলিল: এই অস্ত্র—দুরাচারের মাথা কাটিতে এই-ই অস্ত্র। সাহস হইল, বুকেও বল বাঁধিল। হ্যাঁ, পারিব—সে অমুল্য রত্ন, রমণীকুলের মহামুল্য রত্ন দস্যু-হস্ত হইতে রক্ষা করিতে নিশ্চয়ই পারিব। প্রতিজ্ঞা করিলাম: হয় দস্যুর জীবন, নয় ধনাধিকারিণীর জীবন এই ছুরিকার অগ্রে,— হয় এ ছুরিকা এজিদের বক্ষে প্রবেশ করিবে, নয় জয়নাবের চির-সন্তাপিত হৃদয়-শোনিত পান করিবে। আর চিন্তা কি? নির্ভয়ে সাহসে নির্ভর করিয়া বসিলাম। পাপীর চক্ষু, এ পাপচক্ষে‌ কখনই দেখিব না ইচ্ছা ছিল। কিন্তু নিয়তির বিধানে সে প্রতিজ্ঞা রক্ষা হইল না। দামেস্কে আসিরামাত্রই এজিদের আজ্ঞা প্রতিপালন করিতে হইল। পাপীর কথা শুনিলাম, উত্তর দিলাম, সঙ্গে সঙ্গে ছুরিকাও দেখাইলাম। মহাপাপীর হৃদয় কম্পিত হইল। তাহার মুখের ভাবে বুঝিলাম, নিজ-প্রাণের ভয় অপেক্ষা জয়নাবের প্রাণের