80 বীরবলের হালখাতা চাবুকের প্রয়োগ চলেনা। কোনো লেখক যদি নিতান্ত অপদাৰ্থ হয়, তা হলে তার উপর কশাঘাত করাটা কেবল নিষ্ঠুরতা ; কেননা, গাধা পিটে ঘোড়া হয় না। অপরপক্ষে যদি কোনো লেখক সত্যসত্যই সরস্বতীর বরপুত্র হন, তা হলে তঁর লেখার কোনো বিশেষ অংশ কিংবা ধরন মনোমত না হলেও, সেই বিশেষ ধরনের প্রতি যেরূপ বিদ্রুপ সংগীত, সেরূপ বিন্দ্রপকে আর যে নামেই অভিহিত করা, 'চাবুক' বলা চলে না। কারণ, ওরূপ ক্ষেত্রে কবির মর্যাদা রক্ষা না করে বিদ্রুপ করলে সমালোচকেরও আত্মমৰ্যাদা রক্ষিত হয়। না। কোনো ফাক পেলেই কলি যেভাবে নলের দেহে প্ৰবেশ করেছিলেন, সমালোচকের পক্ষে সেইভাবে কবির দেহে প্ৰবেশ করা শোভনও নয়, সংগতিও নয়। চাবুক ব্যবহার করবার আর-একটি বিশেষ দোষ আছে। ও কাজ করতে করতে মানুষের খুন চড়ে যায়। দ্বিজেন্দ্রবাবুরও তাই হয়েছে। তিনি একমাত্র 'চাবুকে' সন্তুষ্ট না থেকে, ক্ৰমে “ঝটিকা’ 'চাটিকা’ প্ৰভৃতি পদার্থেরও প্রয়োগ করবার চেষ্টা করেছেন। আমি বাংলায় অনাবশ্যক ‘ইক’-প্ৰত্যায়ের বিরোধী। সুতরাং আমি নিৰ্ভয়ে দ্বিজেন্দ্ৰবাবুকে এই প্রশ্ন করতে পারি যে, 'চাটিকা’র ‘ইক’ বাদ দিয়ে যা অবশিষ্ট থাকে, সে জিনিসটে মারাতে কি কোনো লেখকের পদমৰ্যাদা বৃদ্ধি পায় ? “বাঁটা’ সম্বন্ধে আমার বক্তব্য এই যে, সম্মার্জনীর উদ্দেশ্য ধুলোঝাড়া, গায়ের ঝালবাড়া নয়। বিলেতিসরস্বতী মাঝে মাঝে রণচণ্ডী মূর্তি ধারণ করলেও বঙ্গসরস্বতীর পক্ষে ঝাটা উচিয়ে রঙ্গভূমিতে অবতীর্ণ হওয়াটা যে নিতান্ত অবাঞ্ছনীয়, এ কথা বোধ হয়। কেউ অম্বীকার করবেন না। W শ্ৰীযুক্ত দ্বিজেন্দ্রলাল রায় নিজে মার-মূর্তি ধারণ করবার যে কারণ দেখিয়েছেন, আমার কাছে সেটি সব চেয়ে অদ্ভুত লাগল। দ্বিজেন্দ্ৰবাবুর মতে, “যদি কোনো কবি কোনো কাব্যকে সাহিত্যের পক্ষে অমঙ্গলকর বিবেচনা করেন, তাহা হইলে সেরূপ কাব্যকে সাহিত্যক্ষেত্ৰ হইতে চাব কাইয়া দেওয়া তঁহার কর্তব্য’। এক কথায়, সাহিত্যের মঙ্গলের জন্য নৈতিক চাবুক মারাই দ্বিজেন্দ্রবাবুর অভিপ্ৰায়। পৃথিবীতে অনেক লোকের ধারণা যে কাউকে ধর্মাচরণ শেখাতে হলে মৃত্যুর মতো তার চুল চেপে ধরাটাই তার সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়, এবং সেইজন্য কর্তব্য । স্কুলে জেলখানায় ঐ সমাজের মঙ্গলের জন্যই বেত মারবার নিয়ম প্ৰচলিত ছিল। কিন্তু আজকাল অনেকেরই এ জ্ঞান জন্মেছে যে, ও পদ্ধতিতে সমাজের কোনো মঙ্গলই সাধিত হয় না ; লাভের মধ্যে, শুধু, ষে বেত মারে এবং যাকে মারা হয়, উভয়েই তার ফলে মনুষ্যত্ব হারিয়ে পশুত্ব লাতি করে।
পাতা:বীরবলের হালখাতা - প্রমথ চৌধুরী.pdf/৩৮
অবয়ব