পাতা:বৃহৎ বঙ্গ - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/১১৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শ্ৰীকৃষ্ণ ও ভীমার্জ্জুন যে ভাবে যাইয়া তাহাকে হত্যা করেন, তাহা নীতিবিগর্হিত। তাঁহারা স্নাতক ব্ৰাহ্মণের ছদ্মবেশে গুপ্তদ্বার দিয়া মগধ রাজধানীতে গিয়াছিলেন। তাঁহারা গুপ্তভাবে জরাসন্ধের বিশ্ববিশ্রুত ভেরীত্ৰয় এবং সুপ্ৰতিষ্ঠিত চৈত্যশৃঙ্গ ভগ্ন করিয়া ভিক্ষুক ব্ৰাহ্মণের বেশে রাজসভায় উপস্থিত হইলেন। জরাসন্ধ অতি বিনয়ের সহিত তাহাদিগের আতিথ্যসৎকার করিতে উদ্যত হইলেন। কৃষ্ণ তাহা গ্ৰহণ করিলেন না। তাই বলিয়া জরাসন্ধ যে তাঁহাদের কাৰ্য্যাবলীর খবর রাখিতেন না, তাহা নহে। গুপ্ত চরের মুখে তাহাদের প্ৰবেশ অবধি চৈত্য ও ভেরী-ভঙ্গের সমস্ত খবরই তিনি জানিতেন; কিন্তু আতিথ্য-ধৰ্ম্মের প্রতি বিশেষ শ্ৰদ্ধার জন্য তিনি গৃহাগত স্নাতক ব্রাহ্মণবেশীদিগের প্রতি কিছুমাত্র প্ৰতিকুলাচরণ করেন নাই। কৃষ্ণ যখন বলিলেন, “আমরা তোমার শত্ৰু,” তখন ইচ্ছা করিলে তিনি তাঁহাদিগকে নিজের করায়ত্তে পাইয়া যথেচ্চ ব্যবহার করিতে পারিতেন। সেই অদ্বিতীয় বীরসম্রাট বিনীত ও শান্তভাবে বলিলেন, “কই, আমি ত আপনাদের কোন অনিষ্ট করিয়াছি বলিয়া মনে হয় না।” এরূপ সংযতেন্দ্ৰিয় বিনয়ান্বিত পুরুষকে শুধু ক্ষাত্রবীর বলিয়া নহে- একজন ধৰ্ম্মনিষ্ঠ নীতিমান পুরুষ বলিয়াও গ্ৰহণ করা যাইতে পারে। কৃষ্ণ যখন পাণ্ডবগণের সহিত মগধে যাত্রা করেন তখন তাঁহার সন্দেহ হইয়াছিল,- এইভাবে গোপনে জরাসন্ধকে হত্যা করিতে পারিলেও “তাঁহার অন্যান্য স্বপক্ষগণ কর্তৃক তাঁহারা নিহত হইতে পারেন।”

জরাসন্ধের অপূর্ব্ব সংযম

কিন্তু যখন কৃষ্ণাৰ্জ্জুন ও ভীম তাঁহাকে যুদ্ধে আহবান করিলেন-তখন জরাসন্ধ স্বীয় সৈন্যগণ দ্বারা বা তাঁহার বিশ্বজয়ী সেনাপতিদিগের দ্বারা তাঁহাদের বধ-সাধনে প্ৰবৃত্ত হইলেন না। কৃষ্ণকে তিনি 'দাস' বলিয়া ঘূণা করিতেন-(মহা, সভা, ৪১ অঃ ১ম শ্লোক), তাই তাঁহার সঙ্গে যুদ্ধ করিতে ইচ্ছুক হইলেন না। অর্জ্জুনাপেক্ষা ভীমকেই সমধিক দৈহিক বলসম্পন্ন দেখিয়া তাহাকেই তাহার কথঞ্চিৎ যোগ্য প্ৰতিদ্বন্দ্বী বলিয়া মনোনীত করিলেন। তখন মহারাজ জরাসন্ধ কোন ব্ৰত পালন করিয়া উপবাসী ও পরিশ্রান্ত ছিলেন, এই অবস্থায় তিনি ভীমের সহিত যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত হইলেন। যুদ্ধের পূর্ব্বে তিনি তৎপুত্ৰ সহদেবকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করিলেন; যুদ্ধক্ষেত্রে বহু বৈদ্য নানারূপ প্ৰলেপ ও ঔষধ লইয়া উপস্থিত রহিলেন, ইহাই তাৎকালিক দ্বৈরথ যুদ্ধের নীতি ছিল। জরাসন্ধের আত্মীয় সুহৃৎ ও অসংখ্য সৈন্য তামাসগীরের মত কুতুহলী হইয়া সেই ক্ষেত্রে উপস্থিত রহিলেন। জরাসন্ধ অক্ষরে অক্ষরে ক্ষত্ৰনীতি পালন করিয়াছিলেন। কত বড় সংযম তাঁহার ছিল যে উপবাসক্লিষ্ট শরীরে—বিশ্বের সর্ব্বশ্রেষ্ট সৈনিক ও সামন্ত-রাজগণ-পরিবৃত থাকিয়াও—সমস্ত সুবিধা তৃণবৎ উপেক্ষাপূর্ব্বক স্বীয় প্রাসাদে, স্বগণের মধ্যে, নিরাশ্রয় অবস্থায় কুটচক্ৰী শত্রুগণের যুদ্ধের আহ্বান এইভাবে গ্ৰহণ করিতে পারিয়াছিলেন এবং তিনজন যোদ্ধার মধ্যে যাহাকে দৈহিক বলে ও পদমৰ্য্যাদায় যোগ্যতম মনে করিয়াছিলেন তাহাকেই স্বীয় প্রতিদ্বন্দিরূপে মনোনীত করিয়াছিলেন! এহেন অকুতোভয় ক্ষাত্ৰনীতির সাক্ষাৎ আদর্শস্বরূপ। বীরবরের উপবাস ও ব্রাতধারণের কথা জানিয়াও তাঁহার প্রতিদ্বন্দ্বীরা তদ্দত্ত সমস্ত সুবিধা ধ্বিধাশূন্যভাবে অম্লানচিত্তে গ্রহণ করিলেন, ইহাই আশ্চর্য্যের বিষয়। জরাসন্ধের