পাতা:ভারতকোষ - প্রথম খণ্ড.pdf/৪৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

________________

অচিন্ত্যভেদাভেদবাদ থাকায় তাহার সকল ইন্দ্রিয়ই সকল ইন্দ্রিয়ের বৃত্তি ধারণ করে। সচ্চিদানন্দবিগ্রহ ব্রহ্মের চক্ষু-কৰ্ণাদিও সচ্চিদানন্দ, তাহার প্রত্যেক ইন্দ্রিয়ই সর্বশক্তিসম্পন্ন। জীবের চক্ষু-কণাদি তঁাহার স্বগত ভেদ নির্দেশ করে, কিন্তু ব্রহ্মের ইন্দ্রিয়াদি তাহার স্বগত ভেদ নির্দেশ করে না। ব্রহ্মের ইন্দ্রিয়াদি ব্ৰহ্মনিরপেক্ষ নহে। ব্ৰহ্ম অনাদিকাল হইতে যে সকল ভগবৎস্বরূপে আত্মপ্রকাশ করিতেছেন, সেই সকল ভগবৎস্বরূপও তাঁহার স্বগত ভেদ নহে, কারণ কোনও ভগবৎস্বরূপই স্বয়ংসিদ্ধ নহে। ভগবদ্ধাম এবং ভগবৎ-পরিকরাদিও স্বয়ংসিদ্ধ নহে। ইহারাও ব্রহ্মাপেক্ষ। সুতরাং ইহাদিগকেও ব্রহ্মের স্বগত ভেদ বলা সংগত নহে। এইভাবে প্রতিপন্ন হয় যে, পরব্রহ্ম ত্রিবিধভেদরহিত অদ্বয়তত্ত্ব। বৃহত্ববাচক বৃংহ ধাতু হইতে ব্রহ্মপদটি নিষ্পন্ন করা হইয়াছে। বৃংহ ধাতুর একটি অর্থ নিজে বড় হওয়া, আর একটি অর্থ অপরকে বড় করা। যিনি নিজে বড় এবং অপরকে ও বড় করেন তিনিই ব্ৰহ্ম। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে উক্ত হইয়াছে যে, ব্রহ্মের সমানও দেখা যায় না, তাহা অপেক্ষা বড়ও দেখা যায় না (শ্বেতাশ্বতর ৬৮ )। এই উক্তি হইতে বুঝা যায় যে তিনি সর্ববিষয়ে সর্বাপেক্ষা বৃহৎ। উক্ত উপনিষদে ইহাও কথিত হইয়াছে যে, ব্রহ্মের শুধু একটু শক্তি নহে, বহু শক্তি আছে এবং প্রত্যেকটি শক্তিই তাহার স্বাভাবিক শক্তি। যিনি সর্ববিধ শ্রেষ্ঠ শক্তিসম্পন্ন, তাহার নিশ্চয়ই অপরকে বড় করিবার শক্তি আছে। উক্ত উপনিষদে ব্রহ্মের জ্ঞানের ক্রিয়া এবং ইচ্ছার ক্রিয়ার কথাও স্পষ্টাক্ষরে বলা হইয়াছে। বৃংহ ধাতুর দুইটি অর্থ চরম সীমা পর্যন্ত বিস্তৃত করিয়া লইলে বুঝা যায় যে, ব্রহ্মের কোনও দিকে কোনও অন্ত নাই, তিনি অনন্ত। স্বরূপে, শক্তিতে, শক্তির কার্যে এবং প্রকাশবৈচিত্রীতে তাহার আনন্ত্য অবশ্যস্বীকার্য। শ্রুতি যখন তঁাহার স্বাভাবিক শক্তির কথা বলিয়াছেন তখন তাহার সশক্তিকত্ব এবং সবিশেষত্ব অস্বীকার করার কোনও হেতু নাই। ব্রহ্মের শক্তিসমূহের মধ্যে স্বরূপ শক্তিই সর্বশ্রেষ্ঠ। স্বরূপ শক্তিকে চিচ্ছক্তিও বলা হয়, কারণ ইহাতে জড়ত্বের লেশমাত্র নাই ; ইহা জড়বিরােধী এবং চিন্ময়। ইহার আর এক নাম অন্তরঙ্গা শক্তি, যেহেতু ইহার সহিত ব্রহ্মের সম্বন্ধ সর্বাপেক্ষা নিবিড়। ইহা পরা শক্তি নামেও পরিচিত, যেহেতু মায়া শক্তি ও জীব শক্তি নামক অপর দুইটি প্রধান শক্তি অপেক্ষাও ইহা শ্রেষ্ঠ। ব্ৰহ্ম সচ্চিদানন্দস্বরূপ। তাহার চিচ্ছক্তি এক হইয়াও তিন রূপে প্রকাশলাভ করিতেছে। ব্রহ্মের চিচ্ছক্তির সংশের নাম সন্ধিনী। সন্ধিনীর সাহায্যে তিনি নিজের ও অপরের সত্তাকে________________

অচিন্ত্যভেদাভেদবাদ | ধারণ করেন এবং অস্তিত্ববান বস্তুমাত্রকেই সত্তাদান করিয়া থাকেন। ব্রহ্মের চিদংশের শক্তির নাম সংবিৎ শক্তি। স্বয়ং জ্ঞানস্বরূপ হইয়াও ব্ৰহ্ম এই শক্তিদ্বারা নিজে | জানেন এবং অপরকে জ্ঞানদান করেন। ব্ৰহ্ম আনন্দ স্বরূপ। তিনি তাঁহার চিচ্ছক্তির যে বৃত্তিটির সাহায্যে নিজে | আনন্দ আস্বাদন করেন এবং অপরকে আনন্দ আস্বাদন করান তাহার নাম হলাদিনী শক্তি। শ্রীরাধা ইহারই মূর্ত বিগ্রহ। ব্ৰহ্ম নিজেই নিজের আস্বাদ্য। তঁাহার | প্লাদিনী শক্তির প্রভাবে প্রতি ক্ষণে যে আনন্দবৈচিত্রীর সৃষ্টি হইতেছে তাহাও তিনি আস্বাদন করিতেছেন। | তিনি রসম্বরূপ। রস শব্দের দুইটি অর্থ- (১) আস্বাদনের বিষয় এবং (২) আস্বাদক। উভয় অর্থেই তিনি রস। তিনি সর্ববিষয়ে সর্বশ্রেষ্ঠ। তঁাহার পূর্ণতম বিকাশের নাম ভগবান্ । ভগবানে ঐশ্বর্য-মাধুর্যাদি বহু গুণের পূর্ণতম বিকাশ থাকিলেও মাধুর্যই ভগবত্তার সার ; ঐশ্বর্য ভগবত্তার সার নহে। ভগবানের এই স্বাভাবিক মাধুর্য সর্বাকর্ষক ; এইজন্য তঁাহাকে কৃষ্ণ নামে অভিহিত করা হয়। স্বকীয় রসবৈচিত্রীর অনুরূপ তাহার বহু মূর্ত রূপ থাকিলেও দ্বিভুজ নররূপই তাহার যথার্থ রূপ। গােপবেশ, বেণুকর, নবকিশোর, নটবর, পীতাম্বর, ঘনশ্যাম বপুতেও তিনি বিভু, সর্বগ ও অনন্ত। তিনি লীলাময়। তাহার ধামাদি ও লীলাপরিকরগণ তাহারই স্বরূপ শক্তিদ্বারা প্রকটিত। কি প্রাকৃত ব্রহ্মাণ্ডে, কি ভগবদ্ধামাদিতে তত্ত্বতঃ তিনি ব্যতীত আর কিছুই নাই।

শংকরাচার্য বৃংহ ধাতুর প্রথম অর্থটি গ্রহণ করিয়া ব্ৰহ্মকে শুধু বৃহৎ বলিয়াছেন; তিনি ব্রহ্মের গুণ ও শক্তি স্বীকার করেন নাই, তাহার মতে ব্রহ্ম নির্বিশেষ, নিঃশক্তিক। জ্ঞানমাত্র। বঙ্গীয় বৈষ্ণবগণ বলেন যে, শংকরের নির্বিশেষ ব্ৰহ্ম পরব্রহ্ম নহেন, তিনি পরব্রহ্মের শক্তিবৈচিত্রীর ন্যূনতম অভিব্যক্তি, পরব্রহ্মের অঙ্গের কান্তিমাত্র। শংকর যাহাকে ব্ৰহ্ম বলেন তিনিও নিঃশক্তিক নহেন ; নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করিবার শক্তি এবং স্বরূপগত আনন্দময়ত্ব অনুভব করাইবার শক্তি নির্বিশেষ ব্রহ্মেরও আছে। কিন্তু তাহাতে পরব্রহ্ম বা ভগবানের শক্তির অভিব্যক্তির মাত্রা এত অল্প যে, তাহা প্রায় অনুভবযােগ্য নহে। শক্তিবিকাশের তারতম্যানুসারে পরব্রহ্মের অসংখ্য স্বরূপ অভিব্যক্ত হইয়া থাকে ; ইহাদের মধ্যে যে স্বরূপটিতে শক্তির অভিব্যক্তি ন্যূনতম সেই স্বরূপটিকেই সাধারণতঃ ব্রহ্ম নামে অভিহিত করা হয় এবং যে স্বরূপটিতে শক্তিসমূহের অভিব্যক্তি পূর্ণতম সেই স্বরূপটিকে ভগবান্ আখ্যা দেওয়া হয়। শ্রীকৃষ্ণরূপের মধ্যেই পরব্রহ্মের শক্তি, শক্তিকার্য, গুণ,

২১