পাতা:ভারতকোষ - প্রথম খণ্ড.pdf/৪৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

________________

অচিন্ত্যভেদাভেদবাদ সৌন্দর্য ও মাধুর্যের পূর্ণতম বিকাশ। এইজন্য শ্রীকৃষ্ণই স্বয়ং ভগবান্ এবং পরতত্ত্ব। নির্বিশেষ ব্ৰহ্ম এবং শ্রীকৃষ্ণের মধ্যবর্তী যে সকল স্বরূপ আছেন তাহাদের প্রত্যেকেই শ্রীকৃষ্ণের মত সাকার এবং সবিশেষ। সবিশেষ স্বরূপসমূহের মধ্যে যে স্বরূপটিতে সর্বাপেক্ষা নূ্যনশক্তির বিকাশ সেই স্বরূপটির নাম পরমাত্মা। এই স্বরূপটি সাকার হইলেও ইহাতে লীলাবিলাসােপযযাগিনী শক্তির অভিব্যক্তি নাই। যে সকল স্বরূপের মধ্যে পরমাত্মা অপেক্ষা অধিক এবং শ্ৰীকৃষ্ণ অপেক্ষা অল্প শক্তির বিকাশ বিদ্যমান তাহাদের প্রত্যেকেরই ভগবত্ত। স্বীকার্য। রাম, নারায়ণ, নৃসিংহ, সংকর্ষণ প্রভৃতি স্বরূপ ভগবান্ বলিয়া অভিহিত হইয়া থাকেন। কিন্তু তাহাদের মধ্যে ভগবত্তার পূর্ণতম অভিব্যক্তি নাই। শ্রীকৃষ্ণে ভগবত্তার পূর্ণতম বিকাশ আছে বলিয়া তাহাকে স্বয়ং ভগবান্ বলা হইয়া থাকে। শ্রীকৃষ্ণ অবতার নহেন, অবতারী। শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং অনাদি; তিনি সকলের আদি এবং সমস্ত কারণের কারণ। নারায়ণরাম-নৃসিংহ-মৎস্য-কূর্ম-বরাহাদি ভগবৎস্বরূপ শ্রীকৃষ্ণের সহিত অভিন্ন হইলেও তঁাহারা স্বয়ং ভগবান নহেন। তাহাদের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণের শক্তির অশিক প্রকাশ থাকায় তাহাদিগকে স্বাংশস্বরূপ বলা হয় ; শ্রুতি পরব্রহ্মকে সগুণ এবং নি গুণ উভয়ই বলিয়াছেন। মায়িক সত্ত্বাদি গুণের দিক হইতে দেখিলে তিনি নি গুণ, যেহেতু মায়া তাহাকে স্পর্শ করিতে পারে না; কি ও তাহার স্বরূপশক্তির বিলাসভূত অপ্রাকৃত গুণের দিক হইতে দেখিলে তিনি সগুণ। তিনি অনন্ত অপ্রাকৃত গুণের আধার।। পরব্রহ্ম স্বয়ং চিংস্বরূপ। কিন্তু তাহার তিনটি প্রধান শক্তির মধ্যে একটি চিবিরােধিনী, জড়রূপা। এই শক্তির নাম মায়াশক্তি। মায়া অজ্ঞান ; পরব্রহ্ম জ্ঞানস্বরূপ। অন্ধকার যেমন সূর্যকে স্পর্শ করিতে পারে না, অজ্ঞানও সেইরূপ জ্ঞানস্বরূপকে স্পর্শ করিতে পারে না। পরব্রহ্মকে স্পর্শ করার শক্তি মায়ার নাই। পরব্রহ্মের অন্তরঙ্গ চিচ্ছক্তির কার্যস্থল হইতে সর্বদা বাহিরে অবস্থান করে বলিয়া মায়া শক্তিকে বহিরঙ্গা শক্তি বলা হইয়া থাকে। প্রাকৃত ব্রহ্মাণ্ডই এই শক্তির কার্যস্থল। গুণমায়া ও জীবমায়। ভেদে এই শক্তির দুইটি বৃত্তি আছে। স-রজঃতমােগুণময়ী প্রকৃতির নাম গুণমায়া। সাংখ্যেরা বলেন যে, সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ এই তিনটি গুণের সাম্যাবস্থার নাম প্রকৃতি। প্রকৃতি আপনা-আপনি বিভিন্ন বস্তুর বিভিন্ন উপাদানে এবং বিভিন্ন আকারে পরিণত হইতে পারে। স্বতঃপরিণামশীলা প্রকৃতিই জগতের উপাদানকারণ এবং নিমিত্তকারণ। বঙ্গীয় বৈষ্ণবাচার্যগণ বলেন যে, প্রকৃতি

________________

অচিন্ত্যভেদাভেদবাদ জড় বা অচেতন শক্তি বলিয়া আপনা-আপনি পরিণামপ্রাপ্ত হইতে পারে না। শক্তিমান পরব্রহ্ম তাহার দৃষ্টিদ্বারা প্রকৃতিতে শক্তিসঞ্চার না করিলে প্রকৃতির বিক্ষোভ এবং সাম্যাবস্থার নাশ হইতে পারে না। জগতের বিভিন্ন বস্তুর উপাদানরূপে পরিণত হওয়ার যােগ্যতা প্রকৃতির নাই। অগ্নির শক্তিতে লৌহ যেমন দাহক হওয়ার যােগ্যতা লাভ করে সেইরূপ ঈশ্বরের শক্তিতে গুণমায়া জগতের উপাদানরূপে পরিণত হওয়ার যােগ্যতা লাভ করে। অগ্নির শক্তি ব্যতীত লৌহ যেমন কোনও কিছু দগ্ধ করিতে পারে না, সেইরূপ পরব্রহ্মের শক্তি ব্যতীত গুণমায়াও জগতের উপাদানে পরিণত হইতে পারে । পরন্তু লৌহের সাহচর্য ব্যতীতও অগ্নি যেমন অনায়াসে দহনকার্য করিতে পারে সেইরূপ গুণমায়ার সাহচর্য ব্যতীতও পরব্রহ্মের স্বরূপ শক্তির ভগবদ্বাসাদির | উপাদানরূপে পরিণত হইতে পারে। দহনকার্যের মুখ্য কারণ লৌহ নহে, অগ্নি। জগতের মুখ্য উপাদানকারণ গুণমায়া বা প্রকৃতি নহে, পরব্রহ্মের চেতনাময়ী শক্তিই জগতের মুখ্য উপাদান কারণ। গুণমায়া বা প্রকৃতি জগতের গৌণ উপাদানকারণ মাত্র। মায়ার সৃষ্টি-স্থিতিসংহারকারিণী বৃত্তির নাম জীবমায়া। ইহা তাহার আবরণাত্মিক৷ বৃত্তি দ্বারা জীবের স্বরূপ আবৃত করিয়া রাখে এবং বিক্ষেপাত্মিকা বৃত্তি দ্বারা জীবকে জড়বস্তুতে আকৃষ্ট করিয়া তাহার চিত্তবৃত্তিকে বিক্ষিপ্ত করে। অনাদি বহির্মুখ জীব জীবমায়ার প্রভাবে প্রাকৃত ভােগ-লালসা | চরিতার্থ করিবার উদ্দেশ্যে প্রকৃত দেহ স্বীকার করিয়া মায়িক ব্রহ্মাণ্ডে প্রবেশ করে। মায়ামুগ্ধ জীবের প্রাকৃত সুখভােগের নিমিত্ত প্রাকৃত ব্ৰহ্মাণ্ড এবং প্রাকৃত দেহের সৃষ্টি হইয়া থাকে। সুতরাং জীবমায়াকে সৃষ্টির নিমিত্তকারণ বলিয়া মনে হইতে পারে। কিন্তু জীবমায়া দ্বারা সৃষ্টির আনুকূল্য সাধিত হইলেও জীবমায়। জগতের মুখ্য নিমিত্তকারণ নহে। জীবমায় পরব্রহ্মের চিৎশক্তিতে শক্তিমান হইয়াই সৃষ্টির আনুকূল্য করিয়া থাকে। পরব্ৰহ্মই সৃষ্টির মুখ্য নিমিত্তকারণ। দণ্ড-চক্রাদি যেমন ঘটের গৌণ নিমিত্তকারণ, জীবমায়াও সেইরূপ বিশ্বের গৌণ | নিমিত্ত-কারণ। কুম্ভকার যেমন ঘটের মুখ্য নিমিত্তকারণ,

পরব্রহ্ম সেইরূপ জগতের মুখ্য নিমিত্তকারণ। | বঙ্গীয় বৈষ্ণবাচার্যগণ পরিণামবাদী। তাহারা শংকরের | বিবর্তবাদ সমর্থন করেন না। শংকরের মতে ব্রহ্মের সত্তা | পারমার্থিক, জগতের সত্তা ব্যবহারিক। বৈষ্ণবাচাৰ্যদিগের মতে জগৎ নশ্বর হইলেও মিথ্যা নহে। সাংখ্যমতাবলম্বী পরিণামবাদীগণের মতে কার্যের সত্তা কারণের সত্তার

২২