পাতা:ভারতকোষ - প্রথম খণ্ড.pdf/৯৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
অপভ্রংশ সাহিত্য
অপভ্রংশ সাহিত্য

গ্রন্থে বর্ণিত অপভ্রংশ ভাষার বৈশিষ্ট্য তাহাদের মধ্যে দেখা যায়। ইহা ছাড়া, শ্বেতাম্বর জৈনদের আগমগ্রন্থে ( আচা ২, ৪, ৫), বৌদ্ধদের পরবর্তীকালীন গ্রন্থে ( লঙ্কাবতার, ললিতবিস্তার, মহাবস্তু ইত্যাদি), বিমলসূরির (৩য় শতক)। মহারাষ্ট্র প্রাকৃতে লিখিত পউমচরিয়ম্ নামক গ্রন্থে অপভ্রংশ শব্দের কিছু কিছু নিদর্শন পাওয়া যায়। কালিদাসের ( ৫ম শতক) বিক্রমােশীয়’ নাটকের চতুর্থ অঙ্কের গানগুলি অপভ্রংশে রচিত। ইহা হইতে বুঝা যায় কালিদাসের সময়ে বা তাহারও কিছু পূর্বে অপভ্রংশ ভাষার বিকাশ হইয়াছিল।

ভামহ (৭ম শতাব্দী), দণ্ডী (৮ম শতাব্দী) প্রভৃতি আলংকারিকগণ অপভ্রংশ ভাষায় রচিত সাহিত্যকে একটি বিশেষ স্থান দিয়াছেন। ভাষার দিক দিয়া তাহারা কাব্যকে মূলতঃ তিন ভাগে বিভক্ত করিয়াছেন; যথা- সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ। অপভ্রংশে রচিত কাব্যের মান সংস্কৃত বা প্রাকৃত হইতে কোনও অংশেই ন্যন নহে, এই মতও তাহারা ব্যক্ত করিয়াছেন। পরবর্তী কালে পুরুষােত্তম ( ১২শ শতাব্দী) অপভ্রংশকে শিষ্ট লােকের ভাষা বলিয়াই অভিহিত করিয়াছেন।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, প্রাকৃতের মত অপভ্রংশ ভাষার অধিকাংশ গ্রন্থই জৈনগণ কর্তৃক বিরচিত। তাহার তীর্থংকরদের জীবনচরিত অবলম্বনে ‘পুরাণ’ বা চরিতাদি গ্রন্থ, লোকশিক্ষার নিমিত্ত ধর্মকথা’ কাব্য, বিবিধ আখ্যানাদি সংবলিত ‘কথানক’ কাব্য, এমন কি জৈন দর্শন পর্যন্ত অপভ্রংশ ভাষায় রচনা করিয়াছেন।

অধুনা প্রাপ্ত অপভ্রংশ গ্রন্থের মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রাচীন স্বয়ম্ভুদেবের ( ৭ম বা ৮ম শতাব্দী) পউমচরিউ। ইহাতে ৫৬টি সন্ধিতে, ১২০০০ শ্লোকে শ্রীরামচন্দ্রের কাহিনী বর্ণিত হইয়াছে। জৈন শলাকা পুরুষদের মধ্যে অন্যতম শ্রীরামচন্দ্রকে জৈনগণ পদ্ম ( <অপ. পউম) নামে অভিহিত করেন। স্বয়ম্ভু হরিবংশ পুরাণ’ নামে আরও একটি গ্রন্থ রচনা করেন। উভয় গ্রন্থই স্বয়ম্ভু নিজে সম্পূর্ণ করিয়া যাইতে পারেন নাই। তাঁহার পুত্র ত্রিভুবন উহা সম্পূর্ণ করেন। পরবর্তী কালের বাহিলের (বা দাহিরে) পউমসিরিচরিউ এই শ্রেণীর কাব্য। ইহা দশম শতাব্দীতে রচিত। সংস্কৃত মহাভারত সম্পূর্ণভাবে অনুসৃত না হইলেও, কৃষ্ণবলরাম এবং কুরু-পাণ্ডবের কাহিনী ধবলকবি তাহার ‘হরিবংশ পুরাণে’ সুন্দরভাবে বর্ণনা করিয়াছেন।

পুষ্পদন্তের (১০ম শতাব্দী) মহাপুরাণ বা তিসটি মহাপুরিস-গুণালংকার গ্রন্থে ২৪ তীর্থংকর, ১২ চক্রবতী, ৯ বাসুদেব, ৯ বলদেব ও ৯ প্রতিবাসুদেবের জীবনচরিত বর্ণনা
করা হইয়াছে। গ্রন্থখানি আদিপুরাণ ও উত্তরপুরাণ নামে দুইখণ্ডে বিভক্ত। জসহরচরিউ ও নয়কুমারচরিউ নামে তিনি দুইখানি আখ্যানকাব্যও রচনা করিয়াছিলেন। ‘জসহচরিউ’ কাব্যে তিনি রাজা যশােধরের কাহিনী বর্ণনা করিয়াছেন, আর নয়কুমারচরিউ’তে নাগকুমারের কাহিনীকে কাব্যরূপ দিয়াছেন। জৈন মহাপুরুষদের জীবনচরিত অবলম্বনে পরবর্তী কালে অপভ্রংশভাষায় যে সকল গ্রন্থ রচিত হইয়াছিল, তন্মধ্যে হরিভদ্রের ‘নেমিণাহচরিউ’ (১১৫৯ খ্র) এবং পদ্মকীর্তির ( ১৪শ শতক) ‘পার্শ্বপুরাণ’ উল্লেখযােগ্য।

অন্যান্য বিভিন্ন অ্যাখ্যায়িকা বা চরিত অবলম্বনে রচিত অপভ্রংশ কাব্যের মধ্যে ধনপালের (১০ম শতাব্দী) ভবিসয়ত্তক একটি উৎকৃষ্ট রােমান্টিক কাব্য। এই গ্রন্থে লেখক পঞ্চমীব্রতের মাহাত্ম প্রচার করিয়াছেন। এই পঞ্চমী ব্ৰত আষাঢ়, কার্তিক ও ফাল্গুন মাস ধরিয়া চলে এবং পাঁচ বৎসর পালন করার পর পরিসমাপ্ত হয়। এই ব্রত পালনের ফলশ্রুতি হিসাবেই ভবিষ্যদত্তের কাহিনী বিবৃত হইয়াছে। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মাধ্যমে, বৈমাত্রেয় ভাইয়ের চক্রান্ত উপেক্ষা করিয়া, কিরূপে তিনি তাঁহার স্ত্রীকে ফিরিয়া পান, তাহার বিবরণই এই কাব্যের উপজীব্য। কনকামর (১৮৬৫ খ্রী) মুনি কর্তৃক বিরচিত করকণ্ডচরি’ কাব্যে জৈন সাধু করকণ্ডের জীবনচরিত বিবৃত হইয়াছে। করকণ্ড জৈন ও বৌদ্ধ উভয় সম্প্রদায় কর্তৃক পূজিত ছিলেন। ধার্মিকনায়ক বলিয়া বিবেচিত সুদর্শনের কাহিনী অবলম্বনে নয়নন্দী (১০৪৪ খ্রী) সুদর্শন চরিত’ রচনা করিয়া যশস্বী হইয়াছেন। তাহার রচিত ‘আরাধনা’ নামে আর একটি গ্রন্থও আছে। সিংহসেন মেহেসরচরিউ’ (১৪৩৯ খ্ৰী) লিখিয়া প্রসিদ্ধিলাভ করিয়াছেন। তিনি বৈধু’ নামে পরিচিত ছিলেন। বৈধূ নামেই তিনি ‘দহলথণ-জয়মাল’ ও ‘জীবন্ধরচরিত’ লিখিয়াছেন। জীবন্ধচরিতকে অবলম্বন করিয়া অপভ্রংশ ভাষায় বহু গ্রন্থ রচিত হইয়াছে।

‘কথানক’ কাব্যের মধ্যে শ্রীচন্দ্রের (১০ম বা ১২শ শতাব্দী) কথাকোষ’ একটি উৎকৃষ্ট সংকলন জাতীয় গ্রন্থ। ইহাতে ৫৩টি গল্প স্থান পাইয়াছে। গল্পগুলি ঘটনার পারিপাট্যে চিত্তাকর্ষক।

নীতিমূলক অপভ্রংশ কাব্য রচনাতেও জৈনগণ কৃতিত্ব দেখাইয়াছেন। হেমচন্দ্রের সমসাময়িক ও জিনবল্লভ সূরির শিষ্য জিনদত্তসূরি (১০৭৫-১১৫৪ খ্র) তিনখানি নীতিমূলক সংগীতাত্মক কাব্য লিখিয়া যশস্বী হইয়াছেন। তাহার আচার্য জিনবল্লভ সুরির স্তুতিমূলক ‘চচ্চয়ী একটি ৪৭ শ্লোকাত্মক গীতিকাব্য। বহু উপদেশ ও তত্ত্বে পরিপূর্ণ
৭১