পাতা:ভারতকোষ - প্রথম খণ্ড.pdf/৯৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
অপরাধ-বিজ্ঞান
অপরাধ-বিজ্ঞান

করেন। কিন্তু পরবর্তী কালে তাহাদের উভয়ের মতবাদই। ভুল বলিয়া প্রমাণিত হয়। ইটালীয় পণ্ডিত লমূত্ৰসাের মতে লম্বা চোয়াল, শূকরচক্ষু, থ্যাবড়া নাক প্রভৃতি অস্বাভাবিক দৈহিক চিহ্নবিশিষ্ট ব্যক্তি সাধারণতঃ উৎকট অপরাধী হয়। লম্ব্রসাের শিষেরা এই বিষয়ে আরও কিছুদূর অগ্রসর হন। তাহাদের মতে এই সকল শারীরিক লক্ষণ হইতে কোন্ ব্যক্তি কোন্ ধরনের অপরাধ করিতে পারে, তাহা বলিয়া দেওয়া যায়। কিন্তু জার্মান পণ্ডিত গােরিং এই মতবাদ খণ্ডন করেন। তিনি প্রায় তিন হাজার কয়েদীর দেহ পরীক্ষা করিয়া প্রমাণ করেন যে, অপরাধস্পৃহার সহিত দৈহিক লক্ষণের কোনও সম্বন্ধ নাই। গােরিং-এর মতে, চিত্তদৌর্বল্যের জন্যই মানুষ অপরাধ করে। পনর বৎসরের বালকের যেরূপ বুদ্ধি থাকা উচিত, কোনও পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির যদি তাহা অপেক্ষা দুই-চারি বৎসরের কম বয়স্কের মত বুদ্ধিবৃত্তি হয়, তাহা হইলে তাহাকে দুর্বলচিত্ত ব্যক্তি বলা হয়। গােরিং-এর মতে এই সকল দুর্বলচিত্ত ব্যক্তিই হয় উৎকট অপরাধী। তিনি পরীক্ষার দ্বারা এইরূপ বহু দুর্বলচিত্ত অপরাধী বাহির করেন। প্রথম মহাযুদ্ধের সময় সৈনিকদের মধ্যে এইরূপ বহু পরীক্ষা করা হয় এবং দেখা যায় যে, প্রায় দশ লক্ষ সৈন্যের বুদ্ধিমত্তা ঠিক তের বা চৌদ্দ বৎসরের বালকের ন্যায়। কিন্তু তাহাদের কেহই কখনও কোনও অপরাধ করে নাই। কাজেই গােরিং-এর মতবাদও ভুল বলিয়া প্রমাণিত হয়।

বর্তমানে পৃথিবীর অপরাধ-বিজ্ঞানবিগণের অনেকেই প্রাচীন হিন্দুদের মতকেই গ্রহণ করিতে চাহিতেছেন। মানবচরিত্রে অপম্পৃহার অবস্থিতি এবং সুপরিবেশে তাহার সুপ্তি এবং কুপরিবেশে তাহার অভিব্যক্তির কথা সাধারণভাবে স্বীকৃত হইয়াছে। এখন যাহা কিছু মতভেদ তাহা এই অপম্পৃহার উৎপত্তি ও নিবৃত্তির কারণ সম্বন্ধে। একটি মাত্র কারণের জন্য কেহ অপরাধী হয় না। অপরাধী সৃষ্টির পিছনে সাধারণতঃ বহুবিধ কারণ বর্তমান থাকে। কেবল মাত্র অভাব-অভিযোেগ এবং কুপরিবেশ অপম্পৃহা উদ্ভবের কারণ হইতে পারে না। ক্লেপটোম্যানিয়াক প্রভৃতি অপরাধরােগী প্রায়ই ধনী ও শিক্ষিত হইয়া থাকে। তাহাদের ক্ষেত্রে অপম্পৃহা যে অভাব বা পরিবেশজনিত নয় ইহা সুস্পষ্ট।

অপম্পৃহা উৎপত্তির কারণ অনুযায়ী অপরাধীদের প্রধানতঃ দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করা যাইতে পারে- ১. অপরাধ-রােগী এবং ২. নীয়ােগ অপরাধী। এই নীরােগ অপরাধীদের আবার স্বভাব ও অভ্যাস হিসাবে মধ্যম ও
দৈব অপরাধীতে বিভক্ত করা যাইতে পারে। প্রথম অবস্থার অপরাধীদের প্রাথমিক অপরাধী এবং পরিণত অবস্থার অপরাধীদের প্রকৃত অপরাধীও বলা যাইতে পারে। অন্য দিকে মানুষের অপম্পৃহাকেও দুই ভাগে বিভক্ত করা যাইতে পারে, যেমন— দ্রব্যম্পৃহা ও শােণিতস্পৃহা। এই শােণিতস্পৃহা আবার যৌনজ ও অযৌনজ— দুইটি উপবিভাগে বিভক্ত। এই সকল বিষয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদের অন্ত নাই॥

ব্যাবহারিক অপরাধ-বিজ্ঞান বিভাগটিকে তিনটি প্রধান উপবিভাগে বিভক্ত করা যায়। প্রথম বিভাগে প্রবঞ্চক, বিশ্বাসঘাতক, সি দেল চোর, সাধারণ চোর, ডাকাত, অপহারক, বলাৎকারকারী প্রভৃতি বিবিধ যৌনজ ও অযৌনজ অপরাধীদের বাসস্থান, রীতিনীতি, স্বভাব-চরিত্র, সংগঠন, কার্যপদ্ধতি প্রভৃতি বিষয়ের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাসহ বর্ণিত হয়। দ্বিতীয় বিভাগে আলােচনা করা হয় অপরাধ নির্ণয় ও অপরাধ নিবােধের রীতিনীতি। ইহাতে ঘটনাস্থল পরিদর্শন, সাক্ষী ও আসামীর বিবৃতি গ্রহণ, প্রয়ােজনীয় দ্রব্য সংগ্রহ ও উহাদের সংরক্ষণ, খানাতল্লাশ ও দেহতল্লাশ, | গ্রেফতার, জিজ্ঞাসাবাদ, মিছিল ( T. I. Parade) শনাক্তকরণ, টহলদারি ও পাহারাদারির ব্যবস্থা, সাধারণ ও পরিবেশগত প্রমাণ সংগ্রহ ও সােপকরণ ইত্যাদির রীতিনীতির বিবরণ দেওয়া হয়। তৃতীয় বিভাগে অন্তর্ভুক্ত হয়— স্বভাবদুবৃত্ত শ্রেণীর ইতিবৃত্ত ও অপরাধ-পদ্ধতি, পদচিহ্ন এবং অঙ্গুলির ছাপ, সংকেত উদ্ধার ও হস্তলিপিবিদ্যা প্রভৃতি।

অপরাধ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে পদার্থবিদ্যা, রসায়নশাস্ত্র, শারীরবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, নৃতত্ত্ব প্রভৃতি বিজ্ঞান-লব্ধ জ্ঞানের আইনগত ( legal) প্রয়ােগের রীতিনীতি সম্পর্কিত শাস্ত্রকে ফোরেন্সিক সায়েন্স ( Forensic Science) -বলা হইয়া থাকে। ঘটনাস্থলে প্রাপ্ত একটি কেশ, রক্তবিন্দু, ধাতুনির্মিত দ্রব্য, মৃত্তিকা, দগ্ধ বিড়ি-সিগারেটের ভস্ম প্রভৃতি প্রব্যাদির বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা এই ফোরেন্সিক সায়েন্সের সাহায্যে সমাধা করিয়া বহু দুরূহ অপকর্মের মীমাংসা সম্ভব হয়। খাদ্যাদিতে ভেজাল নির্ণয়ের ক্ষেত্রে এই বিদ্যা অপরিহার্য। রাসায়নিক পরীক্ষা ব্যতীত আলট্রাভায়ােলেট প্রভৃতি আলোকরশ্মির দ্বারাও এই সম্পর্কে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হইয়া থাকে। এই বিজ্ঞানের সাহায্যে একটি কেশ বা একবিন্দু রক্ত দেহের কোন্ অংশ হইতে লওয়া হইয়াছে, তাহা যেমন বলা যায়, তেমনই উহা কোন্ মানুষের দেহ হইতে গৃহীত হইয়াছে, তাহাও বহু ক্ষেত্রে | বলা সম্ভব হয়। হত্যা প্রভৃতি অপরাধে এই বিজ্ঞানের
৭৩