পাতা:ভারতবর্ষ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৫২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
৪৬
ভারতবর্ষ।

আবশ্যকপালনকে এক সম্প্রদায় যদি আপন সাম্প্রদায়িক ধর্ম্ম, আপন কৌলিক গৌরব বলিয়া গ্রহণ করেন, তবে বণিগ্‌বৃত্তি সর্ব্বত্রই পরিব্যাপ্ত হইয়া সমাজের অন্যান্য শক্তিকে গ্রাস করিয়া ফেলে না। তা ছাড়া কর্ম্মের মধ্যে ধর্ম্মের আদর্শ সর্ব্বদাই জাগ্রত থাকে।

 ধর্ম এবং জ্ঞানার্জ্জন, যুদ্ধ এবং রাজকার্য্য, বাণিজ্য এবং শিল্পচর্চ্চা, সমাজের এই তিন অত্যাবশ্যক কর্ম্ম। ইহার কোনটাকেই পরিত্যাগ করা যায় না। ইহার প্রত্যেকটিকেই ধর্ম্মগৌরব, কুলগৌরব দান করিয়া সম্প্রদায়বিশেষের হস্তে সমর্পণ করিলে তাহাদিগকে সীমাবদ্ধও করা হয়, অথচ বিশেষ উৎকর্ষসাধনেরও অবসর দেওয়া হয়।

 কর্ম্মের উত্তেজনাই পাছে কর্ত্তা হইয়া আমাদের আত্মাকে অভিভূত করিয়া দেয়, ভারতবর্ষের এই আশঙ্কা ছিল। তাই ভারতবর্ষে সামাজিক মানুষটি লড়াই করে, বাণিজ্য করে, কিন্তু নিত্যমানুষটি— সমগ্র মানুষটি শুদ্ধমাত্র সিপাই নহে, শুদ্ধমাত্র বণিক্‌ নহে। কর্ম্মকে কুলব্রত করিলে, কর্ম্মকে সামাজিক ধর্ম্ম করিয়া তুলিলে, তবে কর্ম্মসাধনও হয়, অথচ সেই কর্ম্ম আপন সীমা লঙ্ঘন করিয়া, সমাজের সামঞ্জস্য ভঙ্গ করিয়া, মানুষের সমস্ত মনুষ্যত্বকে আচ্ছন্ন করিয়া, আত্মার রাজসিংহাসন অধিকার করিয়া বসে না।

 যাঁহারা দ্বিজ, তাঁহাদিগকে একসময় কর্ম্ম পরিত্যাগ করিতে হয়। তখন তাঁহারা আর ব্রাহ্মণ নহেন, ক্ষত্রিয় নহেন, বৈশ্য নহেন—তখন তাঁহারা নিত্যকালের মানুষ—তখন কর্ম্ম তাঁহাদের পক্ষে আর ধর্ম্ম নহে, সুতরাং অনায়াসে অপরিহার্য্য। এইরূপে দ্বিজসমাজ বিদ্যা এবং অবিদ্যা উভয়কেই রক্ষা করিয়াছিলেন—তাঁহারা বলিয়াছিলেন, অবিদ্যয়া মৃত্যুং তীর্ত্ত্বা বিদ্যয়ামৃতমশ্নুতে—অবিদ্যার দ্বারা মৃত্যু উত্তীর্ণ হইয়া বিদ্যার দ্বারা অমৃত লাভ করিবে। এই চঞ্চল সংসারই মৃত্যুনিকেতন, ইহাই অবিদ্যা—ইহাকে উত্তীর্ণ হইতে হইলে ইহার ভিতর