পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/৩০৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিরাটপর্ব
২৭৭

রাজসভায় শোভা পাচ্ছে না। কীচক ধর্মজ্ঞ নয়, মৎস্যরাজও ধর্মজ্ঞ নন, যে সভাসদ্‌গণ তাঁর অনুবর্তী তাঁরাও ধর্মজ্ঞ নন।

 সাশ্রুনয়না দ্রৌপদীর তিরস্কার শুনে বিরাট বললেন, সৈরিন্ধ্রী, আমার অজ্ঞাতে তোমাদের কি বিবাদ হয়েছে তা আমি জানি না। তথ্য না জেনে আমি কি করে বিচার করব? সভাসদ্‌গণ দ্রৌপদীর প্রশংসা এবং কীচকের নিন্দা করতে লাগলেন। তাঁরা বললেন, এই সর্বাঙ্গসুন্দরী যাঁর ভার্যা তিনি মহাভাগ্যবান। এরূপ বরবর্ণিনী মনুষ্যলোকে সুলভ নয়, বোধ হয় ইনি দেবী।

 ক্রোধে যুধিষ্ঠিরের ললাট ঘর্মাক্ত হ’ল। তিনি বললেন, সৈরিন্ধ্রী, তুমি এখানে থেকো না, দেবী সুদেষ্ণার গৃহে যাও। আমার মনে হয় তোমার গন্ধর্ব পতিদের বিবেচনায় এই কাল ক্রোধের উপযুক্ত নয়, নতুবা তাঁরা প্রতিশোধের জন্য দ্রুতবেগে উপস্থিত হতেন। তুমি আর এখানে নটীর ন্যায় রোদন ক’রো না, তাতে এই রাজসভায় যাঁরা দ্যূতক্রীড়া করছেন তাঁদের বিঘ্ন হবে। তুমি যাও, গন্ধর্বগণ তোমার দুঃখ দূর করবেন।

 দ্রৌপদী বললেন, যাঁদের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা দ্যূতাসক্ত সেই অতীব দয়ালুদের জন্যই আমাকে ব্রতচারিণী হ’তে হয়েছে। আমার অপমানকারীদের বধ করাই তাঁদের উচিত ছিল। দ্রৌপদী অন্তঃপুরে চলে গেলেন। তাঁর রোদনের কারণ শুনে সুদেষ্ণা বললেন, সুকেশী, আমার কথাতেই তুমি কীচকের কাছে সুরা আনতে গিয়ে অপমানিত হয়েছ, যদি চাও তবে তাকে প্রাণদণ্ড দেওয়াব। দ্রৌপদী বললেন, কীচক যাঁদের কাছে অপরাধী তাঁরাই তাকে বধ করবেন, সে আজই পরলোকে যাবে।

 দ্রৌপদী নিজের বাসগৃহে গিয়ে গাত্র ও বস্ত্র ধুয়ে ফেললেন। তিনি দুঃখে কাতর হয়ে স্থির করলেন, ভীম ভিন্ন আর কেউ তাঁর প্রিয়কার্য করতে পারবেন না। রাত্রিকালে তিনি শয্যা থেকে উঠে ভীমের গৃহে গেলেন, এবং দুর্গম বনে সিংহী যেমন সিংহকে আলিঙ্গন করে সেইরূপ ভীমকে আলিঙ্গন করে বললেন, ভীমসেন, ওঠ ওঠ, মৃতের ন্যায় শুয়ে আছ কেন? যে জীবিত, তার ভার্যাকে স্পর্শ ক’রে কোনও পাপী বাঁচতে পারে না। পাপিষ্ঠ সেনাপতি কীচক আমাকে পদাঘাত ক’রে এখনও বেঁচে আছে, তুমি কি করে নিদ্রা যাচ্ছ?

 ভীম জেগে উঠে বললেন, তুমি ব্যস্ত হয়ে কেন এসেছ? সুখ দুঃখ প্রিয় অপ্রিয় যা ঘটেছে সব বল। কৃষ্ণা, তুমি সর্ব কর্মে আমাকে বিশ্বাস ক’রো, আমি তোমাকে সর্বদা বিপদ থেকে মুক্ত করব। তোমার বক্তব্য ব’লে শীঘ্র নিজ গৃহে চলে যাও, যাতে কেউ জানতে না পারে।