পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৷৵৹
মহাভারত

প্রপৌত্র জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞে উপস্থিত ছিলেন এবং নিজের শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত পাঠের আদেশ দেন। শাস্ত্রবিশ্বাসী প্রাচীনপন্থী পণ্ডিতগণের মতে কুরুক্ষেত্রযুদ্ধের কাল খ্রী-পূ ৩০০০ অব্দের কাছাকাছি, এবং তার কিছুকাল পরে মহাভারত রচিত হয়। ইওরোপীয় পণ্ডিতগণের মতে আদিগ্রন্থের রচনাকাল খ্রী-পূ চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দের মধ্যে, খ্রীষ্টজন্মের পরেও তাতে অনেক অংশ যোজিত হয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্রের মতে কুরুক্ষেত্রযুদ্ধের কাল খ্রী-পূ ১৫৩০ বা ১৪৩০, তিলক ও অধিকাংশ আধুনিক পণ্ডিতগণের মতে প্রায় ১৪০০। ‘কৃষ্ণচরিত্র’ গ্রন্থে বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন, ‘যুদ্ধের অনল্প পরেই আদিম মহাভারত প্রণীত হইয়াছিল বলিয়া যে প্রসিদ্ধি আছে তাহার উচ্ছেদ করিবার কোনও কারণ দেখা যায় না।’ বর্তমান মহাভারতের সমস্তটা এক কালে রচিত না হ’লেও এবং তাতে বহু লোকের হাত থাকলেও সমগ্র রচনাই এখন কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসের নামে চলে।

 মহাভারতকথা স্বাভাবিক ও অস্বাভাবিক ব্যাপারের বিচিত্র সংমিশ্রণ, পড়তে পড়তে মনে হয় আমরা এক অদ্ভুত স্বপ্নদৃষ্ট লোকে উপস্থিত হয়েছি। সেখানে দেবতা আর মানুষের মধ্যে অবাধে মেলামেশা চলে, ঋষিরা হাজার হাজার বৎসর তপস্যা করেন এবং মাঝে মাঝে অপ্সরার পাল্লায় প’ড়ে নাকাল হন; তাঁদের তুলনায় বাইবেলের মেথুসেলা অল্পায়ু শিশুমাত্র। যজ্ঞ করাই রাজাদের সব চেয়ে বড় কাজ। বিখ্যাত বীরগণ যেসকল অস্ত্র নিয়ে লড়েন তার কাছে আধুনিক অস্ত্র তুচ্ছ। লোকে কথায় কথায় শাপ দেয়, সে শাপ ইচ্ছা করলেও প্রত্যাহার করা যায় না। স্ত্রীপুরুষ অসংকোচে তাদের কামনা ব্যক্ত করে। পুত্রের এতই প্রয়োজন যে ক্ষেত্রজ পুত্র পেলেও লোকে কৃতার্থ হয়। কিছুই অসম্ভব গণ্য হয় না; গরুড় গজকচ্ছপ খান, এমন সরোবর আছে যাতে অবগাহন করলে পুরুষ স্ত্রী হয়ে যায়; মননুষ্যজন্মের জন্য নারীগর্ভ অনাবশ্যক, মাছের পেট, শরের ঝোপ বা কলসীতেও জরায়ুর কাজ হয়।

 সৌভাগ্যের বিষয়, অতিপ্রাচীন ইতিহাস ও রূপকথার সংযোগে উৎপন্ন এই পরিবেশে আমরা যে নরনারীর সাক্ষাৎ পাই তাদের দোষগুণ সংখদুঃখ আমাদেরই সমান। মহাভারতের যা মুখ্য অংশ, কুরুপাণ্ডবীয় আখ্যান, তার মনোহারিতা অপ্রাকৃত ব্যাপারের চাপে নষ্ট হয় নি। স্বাভাবিক মানবচরিত্রের ঘাতপ্রতিঘাত, নাটকীয় ঘটনাসংস্থান, সরলতা ও চক্রান্ত, করুণা ও নিষ্ঠুরতা, ক্ষমা ও প্রতিহিংসা, মহত্ত্ব ও নীচতা, নিষ্কাম কর্ম ও ভোগের আকাঙ্ক্ষা, সবই প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। আজকাল যাকে ‘মনস্তত্ত্ব’ বলা হয়, অর্থাৎ গল্পবর্ণিত নরনারীর আচরণের আকস্মিকতা এবং জটিল প্রণয়ব্যাপার, তারও অভাব নেই। অতিপ্রাচীন ব্যাস ঋষি যেকোনও অর্বাচীন গল্পকারকে এই বিদ্যায় পরাস্ত করতে পারেন।

 জীবন্ত মানুষের চরিত্রে যত জটিলতা আর অসংগতি দেখা যায় গল্পবর্ণিত চরিত্রে ততটা দেখালে চলে না। নিপুণ রচয়িতা যখন বিরুদ্ধ গুণাবলীর সমাবেশ