পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ভূমিকা
৷৶৹

করেন তখন তাঁকে সাবধান হতে হয় যেন পাঠকের কাছে তা নিতান্ত অসম্ভব না ঠেকে। বাস্তব মানবচরিত্র যত বিপরীতধর্মী, কল্পিত মানবচরিত্র ততটা হ’তে পারে না, বেশী টানাটানি করলে রসভঙ্গ হয়, কারণ, পাঠকসাধারণের প্রত্যয়ের একটা সীমা আছে। প্রাচীন কথাকারগণ এ বিষয়ে অবহিত ছিলেন তাতে সন্দেহ নেই। মহাকাব্যের লেখকরা বরং অতিরিক্ত সরলতার দিকে গেছেন, তাঁদের অধিকাংশ নায়কনায়িকা ছাঁচে ঢালা পালিশ করা প্রাণী, তাদের চরিত্রে কোথাও খোঁচ বা আঁচড় নেই। রঘুবংশের দিলীপ রঘু অজ প্রভৃতি একই আদর্শে কল্পিত। মহাভারত অতি প্রাচীন গ্রন্থ, কিন্তু এতে বহু চরিত্রের যে বৈচিত্র্য দেখা যায় পরবর্তী ভারতীয় সাহিত্যে তা দুর্লভ। অবশ্য এ কথা বলা যায় না যে মহাভারতে গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত প্রত্যেক চরিত্রের বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ন আছে। মহাভারত সংহিতা গ্রন্থ, এতে বহু রচয়িতার হাত আছে এবং একই ঘটনার বিভিন্ন কিংবদন্তী গ্রথিত হয়েছে। মূল আখ্যান সম্ভবত একজনেরই রচনা, কিন্তু পরে বহু লেখক তাতে যোগ করেছেন। এমন আশা করা যায় না যে তাঁরা প্রত্যেকে সতর্ক হয়ে একটি পূর্বনির্ধারিত বিরাট পরিকল্পনার বিভিন্ন অংশ গড়বেন, মূল প্ল্যান থেকে কোথাও বিচ্যুত হবেন না। মহাভারত তাজমহল নয়, বারোয়ারী উপন্যাসও নয়।

 সকল দেশেই কুম্ভীলক বা plagiarist আছেন যাঁরা পরের রচনা চুরি করে নিজের নামে চালান। কিন্তু ভারতবর্ষে কুম্ভীলকের বিপরীতই বেশী দেখা যায়। এঁরা কবিযশঃপ্রার্থী নন, বিখ্যাত প্রাচীন গ্রন্থের মধ্যে নিজের রচনা গুঁজে দিয়েই কৃতার্থ হন। এইপ্রকার বহু রচয়িতা ব্যাসের সহিত একাত্মা হবার ইচ্ছায় মহাভারতসমূদ্রে তাঁদের ভাল মন্দ অর্থ প্রক্ষেপ করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র যাকে মহাভারতের বিভিন্ন স্তর বলেছেন তা এইরূপে উৎপন্ন হয়েছে। কেউ কেউ কৃষ্ণের ঈশ্বরত্ব পাকা করবার জন্য স্থানে অস্থানে তাঁকে দিয়ে অনর্থক অলৌকিক লীলা দেখিয়েছেন, কিংবা কুটিল বা বালকোচিত অপকর্ম করিয়েছেন। কেউ সুবিধা পেলেই মহাদেবের মহিমা কীর্তন করে তাঁকে কৃষ্ণের উপরে স্থান দিয়েছেন; কেউ বা গো-ব্রাহ্মণের মাহাত্মা, ব্রত-উপবাসাদির ফল বা স্ত্রীজাতির কুৎসা প্রচার করেছেন, কেউ বা আষাঢ়ে গল্প জুড়ে দিয়েছেন। বঙ্কিমচন্দ্র উত্ত্যক্ত হয়ে ‘কৃষ্ণচরিত্র’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘এ ছাই ভগ্ন মাথামুণ্ডের সমালোচনা বিড়ম্বনা মাত্র। তবে এ হতভাগ্য দেশের লোকের বিশ্বাস যে যাহা কিছু পুঁথির ভিতর পাওয়া যায় তাহাই ঋষিবাক্য, অভ্রান্ত, শিরোধার্য। কাজেই এ বিড়ম্বনা আমাকে স্বীকার করিতে হইয়াছে।’

 বঙ্কিমচন্দ্র কৃষ্ণচরিত্রের জন্য তথ্য খুঁজছিলেন তাই তাঁকে বিড়ম্বনা স্বীকার করতে হয়েছে। কিন্তু যিনি কথাগ্রন্থ হিসাবেই মহাভারত পড়বেন তাঁর ধৈর্যচ্যুতি হবার কারণ নেই। তিনি প্রথমেই মেনে নেবেন যে এই গ্রন্থে বহু লোকের হাত আছে, তার ফলে উত্তম মধ্যম ও অধম রচনা মিশে গেছে, এবং সবই একসঙ্গে পড়তে হবে। কিন্তু জঞ্জাল যতই থাকুক, মহাভারতের মহত্ত্ব উপলব্ধি করতে কোনও বাধা