পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
॥৹
মহাভারত

হয় না। সহৃদয় পাঠক এই জগদ্বিখ্যাত প্রাচীন গ্রন্থের আখ্যানভাগ সমস্তই সাগ্রহে পড়তে পারবেন। তিনি এর শ্রেষ্ঠ প্রসঙ্গসমূহ মগ্ধচিত্তে উপভোগ করবেন এবং কুরচিত বা উৎকট যা পাবেন তা সকৌতুকে উপেক্ষা করবেন।

 মহাভারতে যে ঘটনাগত অসংগতি দেখা যায় তার কারণ—বিভিন্ন কিংবদন্তীর যোজনা। চরিত্রগত অসংগতির একটি কারণ—বহু রচয়িতার হস্তক্ষেপ, অন্য কারণ—প্রাচীন ও আধুনিক আদর্শের পার্থক্য। সেকালের আদর্শ এবং ন্যায়-অন্যায়ের বিচারপদ্ধতি সকল ক্ষেত্রে একালের সমান বা আমাদের বোধগম্য হতে পারে না। মহামতি দ্রোণাচার্য একলব্যকে তার আঙুল কেটে দক্ষিণা দিতে বললেন, অর্জুনও তাতে খুশী। জতুগৃহ থেকে পালাবার সময় পাণ্ডবরা বিনা দ্বিধায় এক নিষাদী ও তার পাঁচ পুত্রকে পুড়ে মরতে দিলেন। দুঃশাসন যখন চুল ধরে দ্রৌপদীকে দ্যূতসভায় টেনে নিয়ে এল তখন দ্রৌপদী আকুল হয়ে বললেন, “ভীষ্ম দ্রোণ বিদুর আর রাজা ধৃতরাষ্ট্রের কি প্রাণ নেই; কুরুবৃদ্ধগণ এই দারুণ অধর্মাচার কি দেখতে পাচ্ছেন না?” দ্রৌপদী বহুবার প্রশ্ন করলেন, ‘আমি ধর্মানুসারে বিজিত হয়েছি কিনা আপনারা বলুন।’ ভীষ্ম বললেন, ধর্মের তত্ত্ব অতি সূক্ষ্ম, আমি তোমার প্রশ্নের যথার্থ উত্তর দিতে পারছি না। বীরশ্রেষ্ঠ শিভালরস কর্ণ অম্লানবদনে দুঃশাসনকে বললেন, ‘পাণ্ডবদের আর দ্রৌপদীর বস্হরণ কর।’ মহাপ্রাজ্ঞ ভীম্ম আর মহাতেজস্বী দ্রোণ চুপ ক’রে বসে ধর্মের সূক্ষ্ম তত্ত্ব ভাবতে লাগলেন। ভীষ্ম-দ্রোণ দুর্যোধনাদির অন্নদাস এবং কৌরবদের হিতসাধনের জন্য প্রাতিজ্ঞাবদ্ধ, কিন্তু দুর্যোধনের উৎকট দুষ্কর্ম সইতেও কি তাঁরা বাধ্য ছিলেন? তাঁদের কি স্বতন্ত্র হয়ে কিংবা যুদ্ধে কোনও পক্ষে যোগ না দিয়ে থাকবার উপায় ছিল না? এ প্রশ্নের আমরা বিশদ উত্তর পাই না। যুদ্ধারম্ভের পূর্বক্ষণে যখন যুধিষ্ঠির ভীষ্মের পদস্পর্শ ক’রে আশীর্বাদ ভিক্ষা করলেন তখন ভীম্ম এই ব’লে আত্মগ্লানি জানালেন—‘কৌরবগণ অর্থ দিয়ে আমাকে বেঁধে রেখেছে, তাই ক্লীবের ন্যায় তোমাকে বলছি, আমি পাণ্ডবপক্ষে যোগ দিয়ে যুদ্ধ করতে পারি না।’ দ্রোণ ও কৃপও অনুরূপ বাক্য বলেছেন। এঁদের মর্যাদাবুদ্ধি বা code of honour আমাদের পক্ষে বোঝা কঠিন। এঁরা পাণ্ডবদের প্রতি পক্ষপাত গোপন করেন না, অথচ যুদ্ধকালে পাণ্ডবদের বহু নিকট আত্মীয় ও বন্ধুকে অসংকোচে বধ করেছেন।

 ভাগ্যক্রমে মহাভারতে চরিত্রগত অসংগতি খুব বেশী নেই। অধিকাংশ স্থলে মহাভারতায় নরনারী স্বাভাবিক রূপেই চিত্রিত হয়েছে, তাদের আচরণ আমাদের অবোধ্য নয়। যেটুকু জটিলতা পাওয়া যায় তাতে আমাদের আগ্রহ ও কৌতৃহল বেড়ে ওঠে, আমরা যেন জীবন্ত মানুষকে চোখের সামনে দেখতে পাই। মূল আখ্যানের ব্যাস শান্তনু ভীষ্ম ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারী কুন্তী বিদুর দ্রোণ অশ্বত্থামা পঞ্চপাণ্ডব দ্রৌপদী দুর্যোধন কর্ণ শকুনি কৃষ্ণ সত্যভামা বলরাম শিশুপাল শল্য