পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/৩২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

খোজাগণ নিঃশব্দে পদচারণ করিতেছে আর রহিয়া বহিয়া মৃদুস্বরে নৈশ বায়ু সেই ইন্দ্রপুরীর উপর বহিয়া যাইতেছে। নরেন্দ্র আপন বিপদকথা ভুলিয়া গেলেন, এই সুন্দর প্রাসাদ, সুন্দর ঘর ও প্রাণ, সুন্দর উদ্যান ও এই অপূর্ব পরিবেশধারিণী রমণীদিগকে দেখিয়া বিস্মিত হইলেন। তিনি কোথায়? এ কোন্ স্থান?

 কতক্ষণ পরে তিনি একটি উন্নত সুবর্ণ-খচিত কবাটের সম্মুখে উপস্থিত হইলেন। সহসা সেই কবাট ভিতর হইতে খুলিয়া গেল। নরেন্দ্র একটি উন্নত আলোকপূর্ণ ঘরে প্রবেশ করিলেন। সহসা অন্ধকার হইতে উজ্জ্বল আলোকে আনীত হওয়ায় কিছুই দেখিতে পাইলেন না। অলোক সহ্য করিতে না পারিয়া হস্তদ্বারা নয়ন আবৃত করিলেন, অমনি শত শত নারী-কণ্ঠ-বিনিঃসৃত হাস্যধ্বনিতে সে উন্নত প্রাসাদ ধ্বনিত হইল।

 নরেন্দ্র জীবনে কখনও এরূপ বিস্মিত হয়েন নাই। কোথায় আসিলেন? এ কি প্রকৃত ঘটনা, না স্বপ্ন? এ কি পার্থিব ঘটনা, না ইন্দ্রজাল? নরেন্দ্র পুনরায় চক্ষু উন্মীলন করিলেন, পুনরায় উজ্জ্বল আলোকচ্ছটায় তাহার নয়ন ঝলসিত হইল। আবার হস্তদ্বারা নয়ন আবৃত করিলেন। পুনরায় শত নারী-কণ্ঠধ্বনিতে প্রসাদ শব্দিত হইল।

 ক্ষণেক পরে যখন নরেন্দ্র চাহিতে সক্ষম হইলেন, তখন যাহা দেখিলেন, তাহাতে তাহার বিস্ময় দশগুণ বর্ধিত হইল। দেখিলেন মর্মর-প্রস্তর বিনির্মিত একটি উচ্চ প্রাসাদের মধ্যে তিনি আনীত হইয়াছেন। সারি সারি প্রস্তরস্তম্ভ উচ্চ ছাদ ধারণ করিয়া রহিয়াছে সে ছাদে ও সে স্তম্ভে যেরূপ বিভিন্ন বর্ণের প্রস্তরে, কারুকার্য দেখিলেন, সেরূপ তিনি জগতে কুত্রাপি দেখেন নাই। স্তম্ভ হইতে স্তম্ভন্তরে সুগন্ধ পুস্পমালা লম্বিত রহিয়াছে, নীচে স্তবকে স্তবকে পুষ্পরাশি সজ্জিত রহিয়াছে, শতনারীকণ্ঠ হইতে পুষ্পমালা দোদুল্যমান হইয়া সুগন্ধে ঘর আমোদিত করিতেছে। ছাদ হইতে, স্তম্ভ হইতে পুষ্প ও পত্ররাশির মধ্য হইতে সহস্র গন্ধদীপ নয়ন ঝলসিত করিতেছে ও সেই সুন্দর উন্নত প্রাসাদ আলোকময় ও গন্ধে পরিপূর্ণ করিতেছে। রেখাকারে শত রমণী দণ্ডায়মান রহিয়াছে, সেই রেখার মধ্যস্থানে দীপালোক-প্রতিঘাতী রত্নরাজিবিনির্মিত উচ্চ সিংহাসনে তাহাদিগের রাজ্ঞী উপবেশন করিয়া আছেন। এ স্বপ্ন না ইন্দ্রজাল? নরেন্দ্র আলফ্ লায়লা পড়িয়াছিলেন যে, এবনহাসেন নামক একজন দরিদ্র ব্যক্তি একদিন নিদ্রা হইতে উখিত হইয়া সহসা দেখিলেন যেন তিনি বোগদাদের খালিফা হইয়াছেন। নরেন্দ্রের স্বপ্ন তদপেক্ষাও বিস্ময়কর, তিনি যেন সহসা স্বর্গোস্তানে আপনাকে অপ্সরাবেষ্টিত দেখিলেন।

৩২