পাতা:মানিক গ্রন্থাবলী.pdf/৩৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
জননী

ফুটেছে, দোলায় চড়ে যাই।’ রাতদুপুরে নিজের মুখে ঘুমপাড়ানো ছড়া শুনিয়া মুখখানা তাহার হাসিতে ভরিয়া যায়। এ ছেলে কার? তার! শ্যামা মানুষ করিতেছে করুক, ছেলে শ্যামার নয়, তার।

 এদিকে শ্যামার ঘুম ভাঙ্গে। কচি ছেলের বুড়ি মা কি আর ঘুমায়? লোক দেখানো চোখ বুজিয়া থাকে মাত্র। উঠিয়া বসিয়া শীতলের কাণ্ড চাহিয়া দেখিতে শ্যামার মন্দ লাগে না। কিন্তু মনকে সে অবিলম্বে শক্ত করিয়া ফেলে।

 বলে — কি হচ্ছে?

 শীতল চমকাইয়া খোকাকে প্রায় ফেলিয়া দেয়।

 শ্যামা বলে — ঘাড়টা বেঁকে আছে। ওর কত লাগছে বুঝতে পারছ?

 — লাগলে কাঁদত। — শীতল বলে।

 — কাঁদবে কি? যে ঝাঁকানি ঝাঁকছ, আঁতকে ওর কান্না বন্ধ হয়েছে। — শ্যামা বলে।

 শীতল প্রথমে ছেলে ফিরাইয়া দেয়। তারপর বলে — বেশ করছি! অত তুমি লম্বা লম্বা কথা বলবে না বলে দিচ্ছি, খপরদার!

 শীতল শুইয়া পড়ে। সে সত্য সত্যই রাগ করিয়াছে অথবা এইটা তার ফাঁকা গর্জন শ্যামা ঠিক তাহা বুঝিতে পারে না। খানিক পরে সে বলে, আমি কি বারণ করেছি ছেলে দেব না! একটু বড় হোক, নিও না তখন, যত খুশী নিও। ওকে ধরতে হলে আমারি এখন ভয় করে! কত সাবধানে নাড়াচাড়া করি, তবু কালকে হাতটা মুচড়ে গেল —

 শীতল বলে, আরে বাপরে বাপ! রাত দুপুরে বকর বকর করে এ যে দেখছি ঘুমোতেও দেবে না!

 শীতলের মেজাজ ঠাণ্ডা হইয়া আসিয়াছে সন্দেহ নাই। রাগ সে করে না, বিরক্ত হয়। মন যে তাহার নরম হইয়া আসিয়াছে অনেক সময় এটুকু গোপন করিবার জন্যই সে যেন রাগের ভান করে, কিন্তু আগের মত জমাইতে পারে না।

 মন্দাকে নেওয়ার জন্য তাহার শাশুড়ী বারবার পত্র লিখিতেছিলেন, মন্দা বারবার জবাব লিখিতেছিল যে পড়িয়া গিয়া তাহার কোমরে ব্যথা হইয়াছে, উঠিতে পারে না, এখন যাওয়া অসম্ভব। শেষ পর্যন্ত শাশুড়ী বোধ হয় সন্দেহ করিলেন। এক শনিবার রাখালকে তিনি পাঠাইয়া দিলেন কলিকাতায়। রাখালের স্নেহ শ্যামা

৪৩