পাতা:মানিক গ্রন্থাবলী.pdf/৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

এ জননীতে গোর্কির মায়ের বৈপ্লবিক গৌরব নেই। শরৎচন্দ্রের মায়েদের মত বিশ্বস্নেহরসের উৎস নয় সে-হৃদয়। কিন্তু সহজ সরল বিশেষত্বহীন স্বাভাবিক পায়ের তলার ঘাসের মত, মাটির মত। তাই অনেক বড়। আদর্শে নয় মমতায় নয়। এত তুচ্ছ মহাত্ম্যহীন এবং এত বড়ো যে শ্যামা ছাড়া অন্য নামে তাকে ডাকা যেত না। বাঙালি তো এই নামেই আদ্যা প্রকৃতিকে দিয়েছে জননীর অভিধা। পাপ-পুণ্য বিচারের ঊর্ধ্বে মানবের দেহ প্রসবিনী বসুন্ধরা - বিষণ্ণ গম্ভীর চতুর প্রসন্ন জননী শ্যামা। আর “কোলে স্পন্দিত হইতে লাগিল জীবন"। যেমনটি সাধারণতঃ হয়ে থাকে। সে জীবনের চেয়ে অনন্ত রহস্যময় আর কি আছে?

॥ সহরতলী॥  (প্রথম পর্ব। উপন্যাস। ১৯৪১।)

 সহরতলীর দেহগত বিস্তার যেন কেন্দ্রাতিগ। বহু নরনারী। কখনও শুধুই জনতার ভীড়। ক্বচিৎ মুখাবয়ব। কেন্দ্র হিসেবে যশোদার চরিত্র যতই শক্তিময়ী হোক সে শ্যামারই কতক অনুবৃত্তি। সন্দেহ নেই, স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব। কিন্তু এদের জন্ম একই উৎসে এবং তা মানিকবাবুর একটি অতিপ্রিয় উওম্যানমোটিফ। যশোদায় শ্যামার সূক্ষ্মতা বা বিকাশ নেই। শ্যামা জননী, যশোদা মৃতবৎসা। মৃত চাঁদ শুধু স্মৃতি, সর্বজনপ্রিয় পরিচয় তার চাঁদের মা। শ্যামার সংসার তার দেহের বিস্তার বলে রক্ত-মাংস-মজ্জার মত সত্য; যশোদার বানানো সংসার গড়ায় ভাঙায় নাড়ীতে টান পড়ে না। যশোদার চরিত্র না হলেও মাতৃত্ব কিছু আদর্শায়িত। তার হোটেলকল্প সংসারে কমিউনিটি কিচেনের সমাজতান্ত্রিক আদল যদি থাকেও সে বন্ধন শিথিলগ্রন্থি।

 যশোদার মনোজীবন আবেগজয়ী। অনেকখানি পুরুষালি অথচ নারীই। নারী ব্যাক্তিত্বসম্পন্ন হয় অভিমানে - শরৎ-সাহিত্যের এ শিক্ষা আর চলল না। যশোদায় মেয়েলি ছলাকলা নেই, পুরুষের দৃঢ়তা আছে। তার বিপুল দেহে নেত্রীর শক্তিতে অরমণীয় রমণীত্ব কিছু ছিল। মতি সুধীর রাজেন ধনঞ্জয় তার প্রমাণ। কারুর গোপন কামনায়, কারুর স্পষ্ট প্রস্তাবে, ঈর্ষার বিষে ওয়াগন ঠেলে প্রতিদ্বন্দ্বী-হননের নির্বিকার চেষ্টায়, কখনও অসহায় আত্মসমর্পণে - যাৱ প্রকাশ।