পাতা:মানিক গ্রন্থাবলী.pdf/৫৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
জননী

 শীতল ভয়ে ভয়ে বলিল — ছ-সাত মাস রাখালের চাকরি ছিল না শ্যামা, আশ্বিন মাসে বোনের বিয়েতে বড্ড দেনায় জড়িয়ে পড়েছে, হাত ধরে এমন করে টাকাটা চাইলে —

 শ্যামার মাথা ঘুরিতেছিল! সাতশো টাকা! রাখাল যে এবার চোরের মতো বাস করিয়া গিয়াছে তাহার কারণ তবে এই? সে সত্যই তাহদের টাকা চুরি করিয়া লইয়া গিয়াছে? টাকা সম্বন্ধে শীতলের দুর্বলতা রাখালের অজানা নয়, এবার সে তাহা কাজে লাগাইয়াছে। মন্দাকেও শ্যামা এবার চিনিতে পারে, অত যে মেলামেশা আমোদ-আহ্লাদ সব তাহার ছল। ওদিকে রাখাল যখন শীতলকে টাকার জন্য ভজাইতেছিল, মন্দা এদিকে তাহাকে নানা কৌশলে ভুলাইয়া রাখিয়াছিল সে যাহাতে টের পাইয়া বারণ করিতে না পারে। এতো জানা কথা যে শীতল আর সে শীতল নাই, সে বারণ করিলে টাকা শীতল কখনো রাখালকে দিত না।

 রাগে দুঃখে সারাদিন শ্যামা ছটফট করিল। যতবার রাখাল ও মন্দার হীন ষড়যন্ত্রের কথা আর টাকার অঙ্কটা সে মনে করিল গা যেন তাহার জ্বলিয়া যাইতে লাগিল।

 কত কষ্টের টাকা তাহার, শীতল তো পাগল, কবে তাহার কমল প্রেসের চাকরি ঘুচিয়া যায় ঠিক নাই, দুটো টাকা জমানো না থাকিলে ছেলেদের লইয়া তখন সে করিবে কি? শীতলকে সে অনেক জেরা করিল,— কবে টাকা দিয়াছে? রাখাল কবে টাকা ফেরত দেবে বলেছে? টাকার পরিমাণটা সত্যই সাতশো, না আরও বেশি? — এমনি সব অসংখ্য প্রশ্ন। শীতলও এখন অনুতাপ করিতেছিল, প্রত্যেকবার জেরা শেষ করিয়া শ্যামা যখন তাহাকে রাগের মাথায় যা মুখে আসিল বলিয়া গেল, সে কথাটি বলিল না।

 শুধু যে কথা বলিল না তা নয়, তাহার বর্তমান বিষণ্ণ মানসিক অবস্থায় এ ব্যাপারটা এমন গুরুতর আকার ধারণ করিল যে সে আরও মনমরা হইয়া গেল এবং কয়েকদিন পরেই শ্যামাকে শোনাইয়া আবোল-তাবোল কি যে সব কৈফিয়ত দিতে লাগিল শ্যামা কিছুই বুঝিল না। শীতল ফাজলামি আরম্ভ করিয়াছে ভাবিয়া সে রাগিয়া গেল। শীতল অনুতপ্ত, বিষণ্ণ ও নম্র হইয়া না থাকিলে এতটা বাড়াবাড়ি করিবার সাহস হয়তো শ্যামাৱ হইত না, এবার শীতলও রাগিয়া উঠিল। অনেকদিন পরে শ্যামাকে একটা চড় বসাইয়া দিল। তারপর সে-ই যেন মার

৬৩