পাতা:মানিক গ্রন্থাবলী.pdf/৬৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মাণিক গ্রন্থাবলী

মেঘের মত টিনের প্রাচীর ডিঙ্গাইয়া, রেলের বাঁধ পার হইয়া কোথায় চলিয়া যায়। আজকাল এসব শ্যামা যেমন ভাবে চাহিয়া দেখে কতকাল তেমনি ভাবে সে তা দেখে নাই। বিকালে ছাদে গিয়ে সে মণিকে ছাড়িয়া দেয়, মণি বকুলের সঙ্গে ছাদময় ছুটাছুটি করে। আলিসায় ভর দিয়া শ্যামা কাছে ও দূরে যেখানে যা কিছু দেখিবার আছে, দেখিতে থাকে, বোধ করে কেমন একটা উদাস উদাস ভাব, একটা অজানা ঔৎসুক্য। পরপর অনেকগুলি গাড়ি রেল-লাইন দিয়া দুদিকে ছুটিয়া যায়, তিনটি সিগনেলের পাখা বারবার ওঠে নামে। ধানকলের অঙ্গনে কুলি মেয়েরা ছড়ানো ধান জড়ো করিয়া নৈবেদ্যের মত অনেকগুলি স্তুপ করে, তারপর হোগলার টুপি দিয়া ঢাকিয়া দেয়। ছোট পুকুরটিতে ধানকলের বাবু জাল ফেলান, মাছ বেশি পড়ে না, এতটুকু পুকুরে মাছ কোথায়?— জাল ফেলাই সার। শ্যামার হাসি পায়। তাহার মামাবাড়ির পুকুরে ও জাল ফেলিলে আর দেখিতে হইত না, মাছের লেজের ঝাপটায় জল খান খান হইয়া যাইত। পারিপার্শ্বিক জগতের দৃশ্য ও ঘটনা শ্যামা এমনিভাবে খুঁটিয়া খুঁটিয়া উপভোগ করে, বাড়ি-ঘর, ধানকল, রেল-লাইন, রাস্তার মানুষ, এসব আর কবে তাহার এত ভাল লাগিয়াছিল? অথচ মনে মনে অকারণ উদ্বেগ, দেহে যেন একটা শিথিল ভারবোধ,— হাইতোলা আলস্য। বিধান আজকাল বিকেলের দিকে শঙ্করদের বাড়ি খেলিতে যায়, ছেলেকে না দেখিয়া তার কি ভাবনা হইয়াছে?

 শীতল বলে — বুড়ো বয়সে তোমার যে চেহারার খোলতাই হচ্ছে গো, বয়েস কমছে নাকি দিনকে দিন?

 শ্যামা বলে — দূর দূর! কি সব বলে ছেলের সামনে!

 শীতলের নজর পড়িয়াছে, শ্যামার ছেঁড়া কাপড় দেখিয়া তাহার চোখ টাটায়, শ্যামার জন্য সে রঙীন কাপড় কিনিয়া আনে। শ্যামা প্রথমে জিজ্ঞাসা করে — ক টাকা নিলে? টাকা পেলে কোথা?

 — হুঁ, কটা টাকা আর পাই নে আমি, উপরি পেয়েছি কাল। একটি পয়সা তো দাও না, আমার খরচ চলে কিসে উপরি না পেলে?

 খরচ চলে? শীতল তাহা হইলে আরও উপরি টাকা পায়, খুশিমত খরচ করে, তাহাকে যে টাকা আনিয়া দেয়, তা-ই সব নয়? শ্যামা রাগিয়া বলে — কি রকম উপরি পাও শুনি?

 — দশ বিশ টাকা, আর কত?

৭২