পাতা:মানিক গ্রন্থাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড).pdf/২৯৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চলিয়া যায়। এ চিন্তাটিরও ধীরে ধীরে মনের দিগন্তে মিলাইয়া যাওয়া উ ছিল, তার বদলে দিন দিন যেন স্পষ্টতর ও অবাধ্য হইয়া উঠিতে লাগিল । শীতের আমেজে দেহের সঙ্কোচন প্রক্রিয়া অনুভব করা যায়, কালীর হাতে সেলাই করা পাড়ের কঁথা গায়ে টানিয়া শেষ রাত্রে বড়ই আরাম বোধ হয়। আধা ঘুম আধা জাগরণের সেই যুক্তিহীন নীতিহীন নিষ্পাপ জগতের আক্ৰান্তব অবলম্বনে একটি অপরূপ নিরাবরণ দেহ আলগোছে ভাসিতে থাকে। বেশী দূরে নয়, হাত বাড়ালেই বােধ হয় স্পর্শ করা যায়, তবু অস্পষ্ট। কোন জীবনের উপযোগী এ দেহ, ভিতরের প্রকৃতির কোন পরিচয় আঁকা আছে। এই দেহের বাহিরে, কিছুই টের পাওয়া যায় না। ঘুম ভাঙ্গিবার পর ছায়া মিলাইয়া যায়, ওই রকম কয়েকটি দেহ পরীক্ষা করিবার ঔৎসুক্য শুধু জাগিয়া থাকে রাজকুমারের। মোটা মোটা ডাক্তারি বই আর নোটবুকগুলির পাতা উল্টাইতে উন্টাইতে এই কথাটা সে মনে মনে নাড়াচাড়া করে। পরীক্ষার জন্য দেহ ভাড়া করা যায়, কিন্তু সে সব নরনারীর দেহ পরীক্ষা করিয়া তার বিশেষ কোন লাভ হইবে না । যাদের সে জানে, যাদের সুখ-দুঃখ-আশা আকাজক্ষার সংবাদের সঙ্গে জীবন যাপনের রীতিনীতির পরিচয় সে রাখে, নিরাবরণ তাদের কয়েক জনকে সে যদি দেখিতে পাইত ! কিন্তু এদের কারো কাছে ইচ্ছাটা জানানো পৰ্যন্ত চলে না । শোনামাত্র যুগ-যুগান্তরের সংস্কারে ঘা লাগিবে, তাকে মনে করিবে পাগল, অসভ্য, বর্বর। বুঝাইয়া বলিলে যে কেউ বুঝিবে সে ভরসা ও রাজকুমারের নাই। সে যে শুধু একটা সত্যের, একটা নিয়মের সন্ধান চায়, কেউ তা বিশ্বাস করিবে না। যতই ভীরু আর লাজুক মনে হোক, উদ্ধত অত্যাচারী সৈনিক বা যন্ত্রীর জীবন ছাড়া শু্যামলের সুখী হওয়ার উপায় কেন নাই , কঞ্চির মত যতই অবাধ্য ও স্বাধীন মনে হোক ৱিণিকে, শাসন-পিপাসু শক্তিমান পুরুষের উপর কলা-বৌ-এর মত নির্ভর করিতে না পারিলে রিণির জীবনে সার্থকতা কেন নাই ; দেশে দেশে নগরে নগরে যাযাবর জীবন কেন শুর কে, এল-এর প্রয়োজন ছিল ; ইতিমধ্যেই চার পাঁচটি সন্তানের মা হইতে না পারায় সরসী কেন সভাসমিতি করিয়া বেড়ায় ; এসব প্রশ্নের জবাব জানিবার প্রয়োজন কেউ বােধ করে না, কৌতুহলও কারো নাই। এগুলি প্রশ্ন বলিয়াই তারা স্বীকার করিতে চায় কিনা সন্দেহ। মানুষের দেহে এই সব রহস্তের নির্দেশ সন্ধান করা ওদের কাছে অর্থহীন উদ্ভট ব্যাপার, ছিছি করার ব্যাপার।