পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/১৭৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in Տ Գ8 মানিক রচনাসমগ্র মাঝে মাঝে করে ফেললেও প্রথা সে সবই মেনে চলে। ঘরে বাইরে কোথাও তার সংস্কার সাধনের প্ৰয়াস নেই। যা আছে তাই তার ভালো, সে সমালোচনা করে না। ঘরে এসে সে এত বেশি করে ঘরের মেয়ে হয়ে যায় বলে গৃহপ্রবাসী পরাশরের মনে হয়। সে একটা অচেনা মেয়ে, কলকাতায় ওর সঙেগ তার কোনোদিন ঘনিষ্ঠত হয়নি, ছেলেবেলার প্রায় ভুলেযাওয়া পরিচয় ছাড়া ওর সঙ্গে তার আর কোনো সম্পর্ক নেই। পদ্মানদীর জোলো বাতাস দিবারাত্রি পরাশরের গায়ে লাগে। কিন্তু সে বাস করে তার একটি নিজস্ব নিঃসঙ্গতার আবহাওয়ায়। শহরেব অনিন্দিতাকে নিয়ে কয়েক ঘণ্টা সময় সে অনায়াসে কাটিয়ে দিতে পারে। কিন্তু এখানে গ্রামের স্তিমিত নরনারীর সঙ্গে এমন করে মিশে গিয়ে সময়ের বহু পিছনে পড়ে-থাকা এখানকার স্থায়ী স্তব্ধতায় এমন করে ডুবে যায় যে তার সান্নিধ্যের সঙ্গ পরাশর পায় না। সকালে গিয়ে হাজির হলে বলে, বসে। রাধাছি। বেঁধে কী করবে। পারিবারিক প্ৰবন্ধ পড়তে বসবে ? বলে পরাশর চলে আসে। বিকালে অনিন্দিতা বলে, বসে। এদের চুলবাঁধা শেখাচ্ছি। এলোচুলে কত রকম খোপা হয় তাই। পরাশর রেগে বলে, নিজের চুল বাঁধবার সময় পাওনি দেখছি! সময় লাগে না। এই দ্যাখেনিমেষে চুলগুলি জড় করে অনিন্দিতা এলোখোপা বেঁধে নেয়। বলে, বসবে না কি ? পরাশর বলে, বসব। নদীর ধারে । তোমার বাড়িতে নয়। চুলবাঁধা শেখানো শেষ করে অনিন্দিতা নদীর ধারে যায়। পরাশরকে দেখতে না পেয়ে ভাবে, কলকাতায় থেকে থেকে একেবারে বখাটে হয়ে গেছে। মিথ্যা কথা মুখে আটকায় না। : দেখা হলে পরাশরকে সে খানিক উপদেশ শোনায়। কলকাতায় ফিরে যেতে বাবণ কবে। গ্রামে থাকতে অনুরোধ জানায়। P জিজ্ঞাসা করে, এ বছর কাঁটা পয়সা ইনকাম হয়েছে? এক পয়সাও নয়। পরাশর সগৌরবে স্বীকার করে। একটা বছর তুমি তবে গ্রামে থাকো এবাব। মনের বিষ কেটে যাবে। কলকাতায় যে তিন-চার হাজার টাকা খরচ করছি সেটা বাঁচাতে পারলেও একটা ইনকাম হচ্ছে ভেবে নিজের ওপর তোমাব একটু শ্রদ্ধাও হবে। নিজেকে ঘূণা করছি বলেই তুমি আরও বেশি গোল্লায় যােচ্ছ মন্টু। পরাশর গলায় বঁাজ এনে বলে, এ রকম উপদেশ ঝাড়তে শিখবে বলেই তোমাকে সংস্কৃত নিতে বারণ করেছিলাম। চালকলাভোজীদের প্রভাব যাবে কোথায় ? তুমি কিছু বোঝা না। তুমি থাকলে আমিও থাকব। তোমার যতক্ষণ খুশি রোজ আমার সঙ্গে এসে ঝগড়া করি। এবার তাহলে আমার একজামিন দেওয়া হবে না। কিন্তু তোমার সংশোধনের জন্য তাতেও আমি রাজি আছি। অনিন্দিতার অনুরোধ ও উপদেশ ভাসা-ভাসা ছাড়া-ছাড়া ছেলেমানুষি নয়। তার বলবার ভঙ্গিতেই বোঝা যায় এ বিষয়ে সে অনেক ভেবেছে। কথা বলার ফঁাকে ফঁাকে সে একটু হাসে, একটু আচার অথবা তেঁতুল-মাখা মুখে দেয়, কপালের বা দিকে গভীর ক্ষতচিহ্নটি অন্যমনস্ক অভ্যাসে বঁাঁ হাতের আঙুল দিয়ে ঘষতে থাকে, সরু চেন্নাহারটি জামার ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়। তার এই পরিচিত মুদ্রাদোষগুলি তার কথাকে হালকা করতে পারে না। পরাশরকে সে যে প্রলোভন দেখায় তাও জোরালো হয়েই থাকে। কিন্তু পরাশর এত রেগে যায় যে তার প্রলোভনে কাজ হয় না।