পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/১৮২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in >brミ মানিক রচনাসমগ্ৰ অনিন্দিতা শাড়ি-গামছা কঁধে ফেলে চশমার খাপ খুঁজছিল, অন্যমনস্ক ব্যস্ততার জন্যই বোধ হয তার কথা বুঢ় শোনাল, গাড়িঘোড়ার ব্যবস্থা তো হয়েছে। শিপ্রা আরও নরম হয়ে বলল, একটা মুশকিল হয়েছে। অনি। মুশকিল বাধা নয়, সর্বনাশের সূচনাও নয়। তবু অনিন্দিতা চশমার খাপের কথা ভুলে গেল। কী মুশকিল শিপ্রাদি? পরাশরের সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে? মুশকিলের বিবরণ দেওয়ার পরিবর্তে শিপ্রা পরাশরের সঙ্গে তার পরামর্শের বর্ণনা খানিক কমিয়ে খানিক বানিয়ে ব্যক্ত করল। মনে হল, এ বিষয়ে তার নিজের যেন কোনো বক্তব্যই নেই। সে শুধু দূতী। পরাশরেরই একটা অনুরোধ সে অনিন্দিতার কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। নিজের ভার বহনে তার অক্ষমতার সকরুণ ভূমিকাটির সঙ্গে ঠিক খাপ না খাওয়ায় কথাগুলিতে এতখানি দুবিনয় প্রকাশ পেল যে অনিন্দিতা গম্ভীর হয়ে গেল। পুকুরে চলো শিপ্রাদি। স্নান করতে করতে পরামর্শ হবে। কোন পুকুরে যাবে? পরাশরদের পুকুরে। পরাশরকেও ডেকে নেব। শুনে শিপ্রার অভিজ্ঞতায় পবিপূর্ণ হৃদয়খানি হঠাৎ আত্মবিস্মৃত হযে গেল। তার মনে হল পৃথিবীর প্রত্যেকটি জীবন যে স্বকেন্দ্রীয় তার এই নির্মল জ্ঞান পরিপূর্ণ সত্য নয়। অনিন্দিতাব মতো মেয়েরা সংসারের বৃঢ়তম নিয়মগুলিকেও মাঝে মাঝে বাতিল করে দিতে পারে। মধু বোসের বাগানে পুকুরটির চারিদিকে এতগুলি ফলের গাছ আছে যে বেলা দশটাব আগে শীতল জলের সঙ্গে উষ্ণ রোদের মিলন হয় না। তারা তিনজনে যখন পুকুরে ঘাটে গিয়ে দাঁড়াল সূর্য তখন আকাশের অনেক নীচে পড়ে আছে, পুকুরের কালো জল নিবিড় ছায়ায় তরল রাত্রির মতো। রহস্যময়। পরাশর ও শিপ্রা মাঝে মাঝে কথা বলার চেষ্টা করেছে, কিন্তু কথায় র্যার দখল অসাধারণ তার মুখে আজ কথা নেই। শুধু কথা নেই নয়, তার মুখের স্বচ্ছ সরলতায় একটা দুর্বোধ্য পাণ্ডর কালিমা ঘনিয়ে এসেছে। মুখের কোন রেখা কীভাবে জটিল বক্রতা অবলম্বন করেছে। কারও পক্ষেই তা অনুমান করা সম্ভব নয, কিন্তু ওর মুখের দিকে তাকালে একটু-একটু ভয় করে। এতকাল নিজস্ব মুখবতায় ওর হ্রদায়ের স্পন্দনটি পর্যন্ত ধ্বনিত হয়েছে, আজ স্তব্ধতা পর্যন্ত মুখর বলে ওকে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। ঘাটে পৌঁছে অনিন্দিতা বললে, তুমি বসো পরাশর। আমরা জলে নামিব। শিপ্রা বললে, আমি যে কাস্টম আনিনি আনি ? অনিন্দিতা বললে, আমিও তো আনিনি! শাড়ি পরে সাঁতার দিতে পারব না। সাঁতার দিতে তোমায় কে বলেছে? হাত ধরে একান্ত অনিচ্ছক শিপ্রাকে অনিন্দিতা একরকম টেনে জলে নামিয়ে নিয়ে গেল। জলের নীচেই ঘাট পিছল। বুক জলে পৌঁছে থামবার চেষ্টা করে শিপ্রা থামতে পারল না, অনিন্দিতার আকর্ষণে তাকে পুকুরের মাঝখানে যেতে হল। হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে সে বললে, হাত ছাড় অনি! ডুবে যাব। অনিন্দিতা বললে, তুমি কতক্ষণ ডুবে থাকতে পার শিপ্রাদি? শিপ্রা কেঁদে বললে, এক সেকেন্ডও পারি না আনি ছেড়ে দে। ঘাটে ফিরে যেতেই প্ৰাণ বেরিয়ে যাবে।