পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৪৫০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in 8Q O মানিক রচনাসমগ্র ইস, কী নেশা দায়িত্বহীনতার, গা-ভাসানোর কী মাদকতা! এই তো সেদিন বিবাহ হইয়াছে মতির, গাওদিয়ার গেয়ো মেয়ে মতি, এর মধ্যে কুমুদের রোগটা তার মধ্যে সংক্ৰমিত হইয়া গেল? তবে, এ কথা সত্য যে বিবাহ বেশি দিনের না হােক সম্পর্ক কুমুদের সঙ্গে তার অনেক দিনের। তালপুকুরের ধারে সাপের কামড় খাওয়ার দিন হইতে ভিনদেশি এই কঁাচপোকা গায়ের তেলাপোকাটিকে সম্মোহন করিয়া আসিতেছে। কুমুদ খুশি হইয়া বলে, আজ তুমি যে এমন মতি ? মতি বলে,— বিন্দে সুধায় আজকে তুমি এমন কেন রাই, অধরা-কোণে দেখছি হাসি, শ্যাম তো কাছে নাই ? কুমুদ বলে, মানে কী হ’ল ? মতি বলে, বলি গো বলি রাই কহিলেন, ওলো বিন্দে, চোখের মাথা খেলি! ওই চেয়ে দ্যাখ! কদমতলে আমরা গলাগলি । কুমুদ আবার বলিল, মানে কী হ’ল ? মানে ? আনন্দের নেশায় এতটুকু গেয়ো মেয়ে ছড়া বলিয়াছে, তারও মানে চাই ? মানে তো মতি জানে না। অপ্রতিভ হইয়া সে মুখ লুকায়। দিন পনেরো পরে নতুন নাটক আরম্ভ হইল। পর পর তিনরাত্ৰি মতি অভিনয় দেখিতে গেল। জয়াকে অনেক সাধ্যসাধনা করিয়াও একদিনের জন্য কুমুদের অভিনয় দেখাইতে সে লইয়া যাইতে পারিল না। কেবল বনবিহারী জয়াকে লুকাইয়া একদিন দেখিয়া আসিল। চুপিচুপি মতির কাছে ংসা করিয়া বলিল যে অ্যাক্ট করাব প্রতিভা আছে কুমুদের। অভিনয় না থাকিলে দুপুরে অথবা সন্ধ্যায্য কুমুদ রিহার্সাল দিতে যায়। কুমুদ না থাকিলে জয়া রাত্রে মতির কাছে শোয়। ভোরে মতির ঘুম ভাঙে না। কুমুদ বাড়ি আসিযা মুখের পেন্ট তুলিতে তুলিতে তাকে একবার ডাকে, স্নান করিয়া আসিয়া একবার ডাকে, তারও অনেক পরে মতি ওঠে। কুমুদকে চা করিয়া দেয় জয়াই। অনেক কিছুই করে জয়া মতির জন্য, তবু অনেক বিষয়ে পর হইয়া থাকে। এমনই ভাবে দিন কাটিতে লাগিল মতির, ঘরের কাজ করিয়া থিয়েটার বাযোস্কোপ দেখিয়া, বেপরোয়া স্মৃর্তি ও গাওদিয়ার জন্য মনোবেদনায়, আর জয়াকে কখনও ঈর্ষা করিয়া কখনও ভালোবাসিয়া। জয়ার কাছে একটু লেখাপড়া শিখিতেও সে আরম্ভ করিয়াছে। যে নাটকে কুমুদ পার্ট বলে সাতদিনের চেষ্টায় সেখানা মতি পড়িয়াও ফেলিল। মনে আবার আকাশস্পশী আশার সঞ্চার হইয়াছে। কত কী কল্পনা করে মতি, গাওদিয়ার সেই পুরানো কল্পনার স্থানে নব নব কল্পনার আবির্ভাব ঘটিয়াছে। তা ছাড়া, এতদিনে আবার যেন নতুন করিয়া কুমুদকে সে ভালোবাসিতে শুরু করিয়াছে। মনে হয়, এই যেন আসল ভালোবাসা ; গাওদিয়ার তালবনের ছায়ায় শুধু ছিল খেলা, এতদিনে রোমাঞ্চমীয় গাঢ় প্রেমের সম্ভাবনা আসিয়াছে। মাঝখানে কী হইয়াছিল মতির ? মনটা কি তার অবসন্ন হইয়া গিয়াছিল? কই, কুমুদের চুম্বনে এমন অনির্বচনীয় অসহ্য পুলক তো জাগিত না-যেন কষ্ট হইত, ভালো লাগিত না। বসন্তকালে এবার কি জীবনে প্রথম বসন্ত আসিল মতির ? কুমুদ যখন বই পড়ে কাজের ফঁাকে বারবার তাহার মুখের দিকে চাহিয়া থাকিতে পারিয়াই কত সুখ মতির ; কুমুদ যখন বাহিরে থাকে তখন দেহে মনে অকারণে কী এক অভিনব পুলক-প্রবাহ অবিরাম বহিয়া যায় ; শিথিল অবসন্ন ভঙ্গিতে বসিয়া থাকিতে যেমন ভালো লাগে, তেমনি ভালো লাগে চলাফেরা হাত-পা নাড়ার কাজ। বাসন মাজার মধ্যেও যেন রসের সন্ধান মেলে। এই ক্ষুদ্র পৃথিবীর সমস্ত দৃশ্যে যেন সুধা ছড়ানো আছে।