পাতা:মার্কস ও মার্কসবাদীদের অজ্ঞতা.pdf/২৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মার্কস ও মার্কসবাদীদের অজ্ঞতা
২৩

থাকাতে ১০০ বছর যেতে না যেতেই তা পৃথিবীর মাটি থেকে উৎখাত হতে চলেছে। মানুষ পশু নয়, তাই মার্কসবাদকে মানুষ পরিত্যাগ করেছে।

 যাই হোক, এবার ধর্মের কথায় আসা যেতে পারে। উপরিউক্ত চার পুরুষার্থের মধ্যে একমাত্র অর্থের স্থান মানুষের বাইরে। জগতে যা কিছু ভোগের সামগ্রী আছে তা সবই অর্থের মধ্যে পড়ে। টাকা-পয়সা বা ধনের বিনিময়ে এই সমস্ত ভোগের সামগ্রীর উপর অধিকার অর্জন করা যায় বলে সাধারণভাবে অর্থ বলতে টাকা-পয়সা বা ধন বোঝায়। পরবর্তী পুরুষার্থ ‘কাম’-এর স্থান হল মানুষের মনে। কাম বলতে বোঝায় মানুষের স্বাভাবিক ইচ্ছা বা কামনার পরিপূর্তি। ইন্দ্রিয়গণ হল কাম পুরুষার্থ চরিতার্থ করার সহায়। চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক, এই পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয়; পায়ু, উপস্থ, হস্ত, পদ ও বাক্য, এই পাঁচটি কর্মেন্দ্রিয় এবং মন হল একাদশ ইন্দ্রিয়। এই ইন্দ্রিয়গণ হল “ধেনুবৎ বৎসায়” অর্থাৎ গাভী যেমন তার বাছুরের দ্বারা আকৃষ্ট হয়, ইন্দ্রিয়গণও সেই রকম কামের দ্বারা আকৃষ্ট হয়। ইন্দ্রিয়গণের দ্বারাই মানুষের মনে কামের উদয় হয়, আবার ইন্দ্রিয়গণের দ্বারাই সে কামের পরিতৃপ্তি হয়। যেমন ভাল খাবারের গন্ধ নাকে গেলে খাবার লোভ জন্মায় এবং খেলে জিহ্বা ইন্দ্রিয়ের দ্বারা সে কাম তৃপ্ত হয়।

 সব মানুষের পক্ষে কাম জয় করে নিষ্কাম হওয়া সম্ভব নয়। আবার সর্বক্ষণ কামের প্রতি ধাবমান হওয়াও সঙ্গত নয়। তাই নিয়ন্ত্রিত কামই সাধারণ মানুষের পথ এবং এখানেই ধর্মের -এর আবির্ভাব। ধর্ম পুরুষার্থের দ্বারা কামকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ধর্মের উৎপত্তি হয় মানুষের বুদ্ধি থেকে—বিশেষভাবে ভাল-মন্দ বা সৎ-অসতের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে মানুষ সমর্থ হয় বুদ্ধি থেকে। কামের প্রতি উদ্ভ্রান্তের মত ধাবিত হওয়া থেকে বুদ্ধি বা ধর্ম মানুষকে রক্ষা করে। রশ্মি (বল্গার দড়ি) যেমন অশ্বকে এবং অঙ্কুশ যেমন হাতীকে নিয়ন্ত্রিত করে, ধর্ম তেমনি মানুষকে নিয়ন্ত্রিত করে। কাজেই ধর্মহীন মানুষ বল্গাহীন রথের মতই উদ্দেশ্যভ্রষ্ট হয়ে কামের প্রতি উদ্দাম গতিতে ছুটে শেষ পর্যন্ত কোনো খানা-ডোবায় হুড়মুড় করে ভেঙে পড়তে বাধ্য। এ থেকে এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে যে, ভারতীয় সংস্কৃতিতে ধর্ম শব্দের অর্থ অত্যন্ত ব্যাপক এবং তা শুধু মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়া বা গীর্জায় গিয়ে উপাসনা করার মত কতকগুলি বাহ্যিক ক্রিয়া সম্পাদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।

 অন্য দিক থেকে বিচার করলে বলা যায় যে, সমাজের প্রতিটি মানুষ যদি কোনো নিয়ন্ত্রণ না মেনে উদ্দাম গতিতে কামের পিছনে ছুটতে থাকে তাহলে মনুষ্য সমাজ আর সুসভ্য সমাজ থাকবে না, অরণ্যের সমাজে পরিণত হবে। কাজেই ধর্ম বলতে উদ্দাম কাম নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে সৃষ্ট সমুদায় সামাজিক বিধি-নিয়মকে বোঝায়। অর্থাৎ ধর্ম হল সমাজ থেকে উদ্ভূত একটি স্বাভাবিক নিয়ম-কানুনের সমষ্টি যা একটা সভ্য সমাজ রক্ষার জন্য প্রয়োজন। এই কারণে অনেকে সংস্কৃত ধর্ম শব্দের প্রতিশব্দ করেছেন “innate law” অথবা “moral value” এবং আমাদের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ ধর্মের প্রতিশব্দ করেছেন “Virtue”। এই কারণেই সংস্কৃত ধৃ ধাতু থেকে ধর্ম শব্দের উৎপত্তি যার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল—যাহা ধারণ করে। বিশেষ অর্থে— যা সমাজকে ধারণ করে। তাই মহাভারতের শান্তি পর্বে ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বলছেন, পুরাকালে রাজাও ছিল না, রাজ্যও ছিল না; দণ্ড ছিল না, দণ্ডাই ব্যক্তিও ছিল না। তখন প্রজারা ধর্মানুসারে পরস্পরকে রক্ষা করত।

 পাশ্চাত্য মতে মানুষ এবং তার ব্যক্তি স্বাধীনতা সকলের উপরে। এই কারণে আজ ইয়োরোপের অনেক দেশে ড্রাগ খাওয়া আইনত অপরাধ নয়, এবং প্রায় সব শহরগুলিতে