পাতা:মার্কস ও মার্কসবাদীদের অজ্ঞতা.pdf/২৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২৬
মার্কস ও মার্কসবাদীদের অজ্ঞতা

ধর্মাবলম্বী বা অবিশ্বাসীদের প্রচণ্ডভাবে ঘৃণা করে থাকেন এবং অনন্ত নরকের আগুনে নিক্ষেপ করেন। তাই এদের ঈশ্বর শুধু বিশ্বাসীদের প্রতিই করুণাময় ভগবান এবং অবিশ্বাসীদের কাছে ক্রোধে চক্ষু রক্তবর্ণ দানব বা জল্লাদ বিশেষ। কিন্তু হিন্দুর ভগবান বলেন— সকলেই আমার কাছে সমান এবং কেউ আমার প্রিয়ও নয়, কেউ আমার বিদ্বেষভাজনও নয় (গীতা—৯/২৮)। অথবা যে আমাকে যেমনভাবে ভজনা করে, আমি তাকে সেই ভাবেই সন্তুষ্ট করে থাকি (ঐ— ১/২৩)।

 দ্বিতীয়ত, এই রিলিজিয়নগুলোকে তুলনা করা চলে আজকের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এবং সেই হিসাবে রিলিজিয়নগুলোও এক ধরনের রাজনৈতিক মতবাদ মাত্র। মানুষের নৈতিক চরিত্র কীভাবে উন্নত হবে, সাধনার দ্বারা আধ্যাত্মিক পথে সে কেমন করে অগ্রসর হবে ইত্যাদি ব্যাপারে এদের কোনো মাথাব্যথা নেই। এদের কথা হল শুধু আমার দলে যোগ দাও তাহলেই সব আপনি-আপনিই হয়ে যাবে, অনন্ত স্বর্গবাসের ব্যবস্থা পাকা হয়ে যাবে। আর আমার দলে যোগ না দিলে অনন্ত নরকের আগুনে পুড়ে মরতে হবে। এইভাবে লোভ দেখিয়ে দলের সদস্যসংখ্যা বাড়াতে হবে। ভালো কথায় কাজ না হলে নির্যাতন, হত্যা ও রক্তপাতের মধ্য দিয়েও সদস্যসংখ্যা বাড়িয়ে যেতে হবে এবং সদস্যসংখ্যা বাড়িয়ে শেষ পর্যন্ত ধর্মের নামে এক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ধর্মের নামে এইসব কার্যকলাপ এবং নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতাকে লক্ষ্য করে বিবেকানন্দ লিখছেন— খ্রিস্টধর্ম চিরকালই তরবারির জোরে প্রচারিত হয়েছে। কি আশ্চর্য, খ্রিস্টের মত নিরীহ মহাপুরুষের শিষ্যরা এত নরহত্যা করেছে। তলোয়ার ছাড়া খ্রিস্টধর্ম কোথায় সফল হয়েছে? ... আমি জানি, তোমাদের পূর্বপুরুষরা কি করে ধর্মান্তরিত হয়েছিল। তাদের সম্মুখে দুটি বিকল্প ছিল, হয় ধর্মান্তর গ্রহণ নয় মৃত্যু, এই তো?

 স্বামীজি আরও লিখছেন,—মুসলমানরা এ বিষয়ে সর্বাপেক্ষা অপরিণত ও সাম্প্রদায়িক ভাবাপন্ন। তাহাদের মূলমন্ত্র, আল্লা এক এবং মহম্মদই একমাত্র পয়গম্বর। যাহা কিছু ইহার বহির্ভূত সে সমস্ত কেবল খারাপই নহে, উপরন্তু সে সমস্তই তৎক্ষণাৎ ধ্বংস করিতে হইবে; যে কোন পুরুষ বা নারী এই মতে সামান্য অবিশ্বাসী তাহাকে নিমেষেই হত্যা করিতে হইবে; যাহা কিছু এই উপাসনা-পদ্ধতির বহির্ভূত তাহাকেই অবিলম্বে ভাঙ্গিয়া ফেলিতে হইবে, যে কোন গ্রন্থ অন্যরূপ মত প্রচার করিয়াছে সেগুলিকে দগ্ধ করিতে হইবে। প্রশান্ত মহাসাগর হইতে আটলাণ্টিক মহাসাগর পর্যন্ত ব্যাপক এলাকায় দীর্ঘ পাঁচশত বৎসর ধরিয়া রক্তের বন্যা বহিয়া গিয়াছে। ইহাই মুসলমান ধর্ম (বিঃ রঃ ঐ, ৫/৪১৭, ৪/১২৫)।

 উপরিউক্ত আলোচনা থেকে এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, ধর্ম এবং রিলিজিয়ন শব্দ দুটি কখনই সমার্থক হতে পারে না। উপরন্তু এটাও বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, হিন্দু বা সনাতন ধর্ম কোনো মতেই ইসলাম বা খ্রিস্টধর্মের সমতুল্য নয়। প্রথমত, হিন্দুধর্মে কোথাও বলা হয়নি যে, যারা হিন্দু নয় তাদের হত্যা করতে হবে বা তারা নরকে যাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। দ্বিতীয়ত, হিন্দুধর্ম মানুষের মধ্যে বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীর বিভেদ সৃষ্টি করে না। হিন্দু এই বিশ্বের সকল মানুষকেই ঈশ্বরের সন্তান, অমৃতের পুত্র বলে বিশ্বাস করে। তাই হিন্দু যখন বলে যে, “সর্বে সুখিনঃ সন্তু, সর্বে সন্তু নিরাময়াঃ” তখন সে বিশ্বের সকল মানুষের জন্যই সুখ-শান্তি ও আরোগ্য কামনা করে, বিশেষ কোনো মানবগোষ্ঠীর জন্য তা করে না। দ্বিতীয়ত, হিন্দু বলে না যে কাউকে ধর্মান্তরিত করে হিন্দু করতে হবে, বা ধর্মান্তরকরণের মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্য বিস্তার করতে হবে। তৃতীয়ত, হিন্দু কখনও বলে না যে, আমি যে ঈশ্বর ভজনা করি সেই খাঁটি ঈশ্বর বা আমি যে পথ অনুসরণ করছি সেটাই শ্রেষ্ঠ পথ। পক্ষান্তরে উদার হিন্দু বলে যে, বিশ্বে ঈশ্বর