প্রাকৃতিক অবস্থানকে আরও সুদৃঢ় করিবার জন্য সম্মুখভাগে পরিখা খনন করিয়া মীর কাসেমের সৈন্যগণ নির্ভীকচিত্তে অবস্থান করিতেছিল। তাঁহারা মনে করিয়া উঠিতে পারে নাই যে, যে-স্থানে দেবতাও সহসা প্রবেশ করিতে পারেন না, সেই স্থানে ইংরেজসৈন্য অনায়াসে প্রবেশলাভ করিতে সমর্থ হইবে। কিন্তু তাঁহারা জানিত না যে, ইংরেজ-চাতুরীর নিকট দৈবশক্তিও প্রতিহত হইয়া যায়। কেবল তাহাদের এই বিশ্বাসের জন্য সতর্কতার অভাবে ইংরেজসৈন্য রাত্রিযোগে নবাবসেনাশিবিরে প্রবেশ করিয়া, গোলাবর্ষণে তাহাদিগকে বিধ্বস্ত করিয়া ফেলে এবং কামানধ্বনিতে উধূয়ার পর্বতশ্রেণী বিকম্পিত করিয়া জাইবীহৃদয়ে মহাতরঙ্গের সৃষ্টি করিয়া তুলে। মীর কাসেমের স্বাধীনচিত্ততার জন্য মূর্ছিতা মুসলমান-রাজলক্ষ্মীর যে-অস্ফুট জ্যোতিঃ বাঙ্গলার ভাগ্যাকাশে পুনর্বার ঈষৎ বিকশিত হইতেছিল, উধূয়ানালায় তাহা চিরদিনের জন্য তমসাচ্ছন্ন হইয়া যায়। ইংরেজও নিঃসন্দিগ্ধভাবে বাঙ্গলার একচ্ছত্রতা লাভ করেন। পলাশী হইতে তাঁহাদের যে-শক্তিপ্রবাহ বঙ্গদেশে প্রবাহিত হইতেছিল, মীর কাসেম-কর্তৃক সময়ে সময়ে ঈষৎ প্রতিহত হওয়ায়, উধূয়ানালায় তাঁহারা তাহার পথ অবাধ করিয়া তুলিয়াছিলেন। আজিও উধূয়ানালা ও তাহার নিকটস্থ পাহাড়শ্রেণী দণ্ডায়মান থাকায় মীর কাসেমের গৌরব-বলি ও ইংরেজ-বিজয়ের ঘোষণা করিয়া সকলের চিত্ত আকর্ষণ করিতেছে।
উধূয়ানালা রাজমহল হইতে প্রায় ৩ ক্রোশ দক্ষিণ-পূর্বে। রাজমহল এক সময়ে বাঙ্গলার রাজধানীপদে প্রতিষ্ঠিত ছিল। বাঙ্গলার প্রাচীন রাজধানী গৌড় মহামারীতে বিনষ্ট হওয়ায়, কিছুকাল টাঁড়ায় রাজধানী স্থাপিত হয়। পরে ১৫৯২ খ্রীঃ অব্দে রাজা মানসিংহ রাজমহলে রাজধানী স্থাপন করেন। লোকে পূর্বে রাজমহলকে আগমহল বলিত। মানসিংহই আগমহলকে রাজমহলে পরিণত করেন। মানসিংহ রাজমহলে আপন বাসনিকেতন ও একটি দেবালয়ও নির্মাণ করিয়া তাহা সুরক্ষিত করিতে চেষ্টা পাইয়াছিলেন। ফতেজঙ্গ নামে বিহারের মুসলমান শাসনকর্তা তৎকালে রাজমহলে থাকিতেন; তিনি সম্রাট আকবরকে লিখিয়া পাঠান যে, মানসিংহ দেবালয় স্থাপন করিয়া কাফের-ধর্মপ্রচার ও বাসনিকেতন সুরক্ষিত করিয়া স্বয়ং স্বাতন্ত্র্য অবলম্বনের চেষ্টা করিতেছেন। মানসিংহ এই সংবাদ অবগত হইয়া, রাজমহলকে আকবরনগরে ও দেবালয়টিকে একটি প্রকাণ্ড জুম্মা মস্জেদে পরিণত করিয়া ফেলেন। পরে স্বীয় উপাসনার জন্য একটি ক্ষুদ্রায়তন মন্দির নির্মাণ করেন। কথিত আছে যে, এইজন্য মানসিংহ পরে ফতেজঙ্গের সহিত কৌশলপূর্বক বিবাদ বাধাইয়া, তাঁহার বাটীপর্যন্ত সুড়ঙ্গ খননপূর্বক বারুদের দ্বারা পূর্ণ করিয়া উক্ত বাটী উড়াইয়া দেন। ফতেজঙ্গের বাটীর ভগ্নাবশেষ আজিও রাজমহলে দেখিতে পাওয়া যায়। মানসিংহ-স্থাপিত, বারদুয়ারী, জুম্মা মস্জেদ, শিবমন্দির প্রভৃতি অদ্যাপি বিরাজ করিতেছে। এই জুমা মস্জেদে একটি প্রকাণ্ড ইন্দারা আছে; তথায় সমস্ত দ্রব্য প্রস্তরীভূত হইয়া যায়।
রাজমহল হইতে রাজধানী ঢাকায় অন্তরিত হয়; অনন্তর সুলতান সুজা পুনর্বার
