বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:মুর্শিদাবাদ কাহিনী.djvu/১৬৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
উধূয়ানালা

 অষ্টাদশ শতাব্দীর যে-মহাবিপ্লবাগ্নি বঙ্গদেশে প্রধূমিত হইতে হইতে পলাশীসমরক্ষেত্রে প্রজ্বলিত হইয়া উঠে, কয়েক বৎসর পর্যন্ত তাহা কখনও প্রধূমিত, কখনও বা ঈষজ্জ্বলিত হইয়া অবশেষে উধূয়ানালায় মুসলমান-গৌরবকে চিরভস্মীভূত করিয়া ফেলে। উধূয়ানালা বাঙ্গলার মুসলমান-গৌরবের শ্মশানভূমি। এইখানে বাঙ্গলার শেষ স্বাধীন নবাব মীর কাসেম আপনার সর্বস্ব বলি দিয়া বঙ্গরাজ্য হইতে বিতাড়িত হইয়া, অবশেষে মনস্তাপে ফকীরি গ্রহণ করিতে বাধ্য হন। যিনি বঙ্গদেশ হইতে ইংরেজক্ষমতা নির্মূল করিবার জন্য মহাবিপ্লবের পুনরবতারণা করিয়াছিলেন, তিনি নিজেই অবশেষে সেই বিপ্লবে শক্তিহীন হইয়া মুঙ্গেরপ্রান্তবাহিনী জাহ্নবীজলে বাঙ্গলার স্বাধীনতা-লক্ষ্মীকে বিসর্জন দিয়া, চিরদিনের জন্য বঙ্গরাজ্য হইতে বিদায় গ্রহণ করেন। যিনি বঙ্গরাজ্যে মুসলমান সিংহাসন অটল রাখিবার জন্য রণকৌশলে স্বীয় সৈন্যদিগকে ইউরোপীয়গণের সমকক্ষ করিয়া তুলিয়াছিলেন, ইংরেজের অমানুষী চাতুরীতে তাঁহার সেই সমস্ত দক্ষতা ব্যর্থ হইয়া যায়। ইংরেজের রক্তে যিনি বঙ্গভূমিকে অভিষিক্ত করিবার ইচ্ছা করিয়াছিলেন, দৈবচক্রে তাঁহারই সৈন্যগণের রক্তে বাঙ্গলার প্রধান প্রধান সমরক্ষেত্র রঞ্জিত হইয়া উঠে। ইংরেজের মোহিনী মায়ায় মুগ্ধ হইয়া মীর কাসেম প্রথমতঃ তাহাদিগের জালমধ্যে আবদ্ধ হইয়া পড়েন; অনেক চেষ্টায় সে জাল ছিন্ন করিলেও তিনি একেবারে নিষ্কৃতি লাভ করিতে পারেন নাই। ইংরেজের অব্যর্থ সন্ধানে তাঁহার দূরপ্রসারিণী শক্তিকে চিরদিনের জন্য বিকলাঙ্গী হইতে হয়। মীর কাসেমের সমস্ত আশাভরসা উধূয়ানালায় বিনষ্ট হইয়া যায়। উধূয়ার পর্বতশ্রেণী তাঁহার সৈন্যদিগকে বেষ্টন করিয়া রাখিলেও, ইংরেজের রণচাতুরী তাহাদিগকে অনায়াসে ভেদ করিতে সক্ষম হইয়াছিল। যে-ইংরেজ বণিকদিগের চাতুরীতে ন্যায়ের অচল ও অটল হিমালয় উৎপাটিত হইয়া পড়িত, উধূয়ার ক্ষুদ্র পাহাড়শ্রেণীর এমন কি সাধ্য ছিল যে, তাহাদের গতিরোধ করিতে সমর্থ হইত? ফলতঃ উধূয়ার সুন্দর অবস্থান পাইয়াও ইংরেজহস্তে মীর কাসেমের সৈন্যদিগকে বিধ্বস্ত হইতে হইয়াছিল।

 মীর কাসেমের সেনাশিবিরের সম্মুখে ও পার্শ্বে উধূয়ার পাহাড়শ্রেণী নাত্যুচ্চ মস্তক উত্তোলন করিয়া শত্রুপক্ষের গতিরোধার্থ দণ্ডায়মান; পশ্চাদ্ভাগে বর্ষার সলিল-প্রবাহে পরিপূর্ণদেহা উধূয়ানালা ফেন উদ্গীরণ করিতে করিতে কুল কুলু ধ্বনিতে গঙ্গাবক্ষে আত্মবিসর্জনে ব্যস্ত; বামে আপনি জাহবী বর্ষার জলপ্লাবনে স্ফীত হইয়া ভৈরব রবে পার্শ্বরক্ষার জন্য নিযুক্ত; দক্ষিণে আরও কতিপয় পর্বতশ্রেণী প্রাচীররূপে অবস্থিত। এই


 ১ উধূয়ানালা প্রচলিত ইতিহাসে উদয়নালা বলিয়া লিখিত হয়। কিন্তু উধূয়ানালাই ইহার প্রকৃত নাম। তদঞ্চলবাসী ও দেশীয় গ্রন্থকারগণ-কর্তৃক ইহা উধূয়ানালা নামেই অভিহিত হইয়া থাকে।