পাতা:মুর্শিদাবাদ কাহিনী.djvu/৩৭৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
একদিনের স্মৃতি
৩৭১

সিরাজি কখনও মনে করে নাই যে, তাহার অনন্ত জীবন আঁধারেই, পর্যবসিত হইবে। যাউক, আঁধারে থাকিবার জন্য যখন তাহার জন্ম, তখন তাহাকে আঁধারেই থাকিতে দেওয়া হউক।

 একটি কথা মনে পড়িল-ইংরেজ ঐতিহাসিকের চক্ষে সিরাজ ঘোর অত্যাচারী। কিন্তু তাহার এমন কোন কি গুণ ছিল না যে, তাহার উল্লেখ করিয়া হতভাগ্যের প্রতি সহানুভূতি দেখান যায়? অনেক দিন হইল, সিরাজের রাজত্বের অবসান হইয়াছে; তাহার পর কোম্পানীর রাজত্ব গিয়াছে। এক্ষণে আমরা যে রাজত্বে বাস করিতেছি তাহার তুলনা নাই; শান্তিময়ী সম্রাজ্ঞী ভিক্টোরিয়া ও তাহার উদারহৃদয় পুত্র রাজরাজেশ্বরের আশ্রয়চ্ছায়ায় অবস্থিতি করিয়া এক্ষণে আমরা তাহার শান্তিপ্রিয় পৌত্রের আশ্রিত। আমাদিগকে শান্তিময় রাজত্বে বাস করিতে দেখিয়া, পৃথিবীর কত লোক হিংসা করিয়া থাকে। কিন্তু এই শান্তিময় রাজত্বে বাস করিয়াও রাজপুরুষগণের অদূরদর্শিতায় শান্তিচ্ছায়ার মধ্যেও কখনও কখনও আতপতাপ অনুভব করিতে হয়। সিরাজের রাজত্বে যাহাই হউক না কেন, বাস্তবিক সেইরূপ অত্যাচারপূর্ণ না হইলেও অনেকের মনকুষ্টির জন্য স্বীকার করিলাম যে, তাহার রাজত্ব ঘোর উপদ্রবময় ছিল; কিন্তু তাহার রাজত্বে আমরা যাহা ভোগ করিয়াছি, এখন তাহা পাই না কেন? সহস্র অত্যাচারময় হইলেও, হতভাগ্য সিরাজকে ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছ৷ হয়। সিরাজ মুসলমান হইয়া কখনও হিন্দুর গুণ অস্বীকার করিত না। সিরাজ বলিয়া কেন, যে দাম্ভিক সম্রাট আরঙ্গজেবের মত হিন্দুবিদ্বেষী কেহ দিল্লীর সিংহাসনে অধিবৃঢ় হন নাই, সেই আরঙ্গজেবই হিন্দুদিগকে উচ্চপদ প্রদান করিতে কুষ্ঠিত হইতেন না। আর সিরাজ, তাহার সময়, দুর্লভরাম প্রধান মন্ত্রী, মোহনলাল সেনাপতি, জগৎশেঠ রাজস্ববিষয়ে সর্বেসর্বা, নন্দকুমার হুগলীর ফৌজদার, আর কত নাম করিব? ইহাদের মধ্যে কেহ কেহ সিরাজের প্রিয়পাত্র ও বিশ্বাসী ছিলেন। সিরাজ তাহাদের পরামর্শ লইয়া অনেক কার্য করিতেন।

 তাই বলিতেছি, সিরাজের অশেষ দোষ থাকিলেও তাহার যে সামান্য গুণ ছিল, তাহাও কেন আমরা বিস্মৃত হই, বুঝিতে পারি না। পাপীর জন্য করুণাপ্রকাশই পুণ্যধর্ম। বিশেষতঃ তাহার অন্ধকারময় জীবনের মধ্যে যদি একটু সামান্য আলোকও দেখা যায়, তাহা হইলে সে আলোকটুকু স্বীকার করিয়া তাহার প্রতি সহানুভূতি দেখান কি উচিত নহে? হতভাগ্য সিরাজের হিন্দু-মুসলমানের প্রতি সমভাব স্মরণ করিয়া তাহার অন্ধকারময় জীবনের মধ্যে একটু আলোক দেখিতে পাইয়া, তাহার প্রতি করুণার উদ্রেক হয়। সিরাজের রাজত্বের সময় হিন্দু-মুসলমানের সমান আধিপত্য ছিল; কিন্তু আজিও আমাদের শাদাকাল ঘুচিল না! তাহার পর সে সময় হিন্দু-মুসলমানে এরূপ প্রতিনিয়ত বিবাদ হইত না। পরস্পর পরস্পরের প্রতি সহানুভূতি ও স্নেহ প্রকাশ করিত। আর এক্ষণে তাহাদের মধ্যে যে ঘোর বিবাদ হইতেছে, তাহার কারণ কি করিয়া বুঝিব? রাজকর্মচারীকে বিবাদ মীমাংসা করিতে দেখি না।