পাতা:মুর্শিদাবাদ কাহিনী.djvu/৪২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
৩৬
মুর্শিদাবাদ-কাহিনী

 যাহা হউক, সরফরাজকে পদচ্যুত করিবার জন্য এক ষড়যন্ত্রের আয়োজন হইল। হাজী আহম্মদ, আলমচাদ ও জগৎশেঠ সকলেই অবমানিত হওয়ায়, নিজ নিজ অবমাননার প্রতিশোধার্থ পাটনা হইতে আলিবর্দী খাঁকে আহবান করিলেন। আলিবর্দী সসৈন্যে মুশিদাবাদাভিমুখে অগ্রসর হইয়া নিজ যাত্রার কথা জগৎশেঠকে ও নবাবকে লিখিয়া পাঠান। নবাবকে চতুরতাপূর্বক তিনি ষে-পত্র লিখিয়াছিলেন, তাহাও জগৎশেঠের নিকট প্রথমে প্রেরিত হয়। জগৎশেঠ পরে তাহা নবাবকে প্রদান করেন। গিরিয়ার প্রাস্তরে সরফরাজের সহিত আলিবর্দীর ভীষণ যুদ্ধ উপস্থিত হয়। সায়র মুতাক্ষরীনে লিখিত আছে যে, নবাবপক্ষ-কর্তৃক জগৎশেঠ আলিবর্দী খাঁর সৈন্যাধ্যক্ষদিগের নিকট টিপ[১] প্রেরণ করিতে নিযুক্ত হন। টিপ প্রেরণের এইরূপ উদ্দেশ্য ছিল যে, আলিবর্দীর কর্মচারিগণ অর্থ পাইয়া তাহাকে ধৃত করিয়া সরফরাজের নিকট উপস্থিত করবে। কিন্তু মুতাক্ষরীনের অনুবাদক বলেন, আলিবদা ঁখা ঁনিজেই ঐরূপ কৌশল করিয়া স্বীয় বন্ধু জগৎশেঠের দ্বারা সরফরাজের কর্মচারিগণকে বশীভূত করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন এবং ইহাই সাধারণ লোকে অবগত ছিল। অনুবাদকের সময় সরফরাজের একজন কর্মচারী জীবিত ছিল। সে এইরূপ প্রকাশ করিয়াছিল যে, তাহাকে ৪ হাজার টাকার একখানি টিপ দেওয়া হয়। তাহ পাইয়া সে বারুদের পরিবর্তে ধূলামাটি পূর্ণ করিয়া তোপ ছাড়িতে ইচ্ছা করিয়াছিল। অনুবাদক বলেন, অনেকে বাস্তবিকই ঐরূপ ধূলামাটি পূর্ণ করিয়া কামান ছাড়িয়াছিল।[২]

 গিরিয়ার যুদ্ধে সরফরাজ নিহত হইলে, আলিবর্দী খা ঁবাঙ্গলার সিংহাসনে অধিবৃঢ় হন। কিন্তু ইহাতে জগৎশেঠ প্রভৃতির প্রশংসা করা যায় না। ফতেচাদের ন্যায় একজন বার্ধক্যদশায় উপনীত লোকের বিশ্বাসঘাতকতা ও ষড়যন্ত্রের দ্বারা নিজ অবমাননার প্রতিশোধ লইতে ইচ্ছা করা কদাচ সঙ্গত বলিয়া বোধ হয় না। বিশেষতঃ, শেঠ-বংশীয়দের প্রবাদানুসারে বাস্তবিক যদি মুশিদকুলীর গচ্ছিত অর্থ প্রত্যপণ না করায় সরফরাজের সহিত তাঁহার মনোবিবাদ ঘটিয়া থাকে, তাহা হইলে, তাহার ব্যবহার যে নিতান্ত নিন্দনীয়, সে বিষয়ে কিছুমাত্র সন্দেহ থাকিতে পারে না। যদি সরফরাজের প্রতি তাঁহার বিশিষ্টরূপ বিরক্তি জন্মিয়া থাকত, তিনি অনায়াসে তাহার অন্য উপায় করিতে পারিতেন। বাদশাহ-দরবারে তাহদের যেরূপ প্রতিপত্তি ছিল, তাহাতে তাঁহারা নবাবের অত্যাচার বাদশাহের কর্ণগোচর করিয়া, প্রকাশ্যভাবে তাহার পদচ্যুতি ঘটাইতে পারিতেন। ফলতঃ, ফতেচাঁদের ঈদৃশ ব্যবহার আমরা কোনরূপে সমর্থন করিতে পারি না।

  1. বর্তমান নোট বা চেকের ন্যায় কাগজ, তাহাতে টাকা দিবার আদেশ লিখিত হইত।
  2. Mutaqherin (Trans.), Vol. I, p. 363. রিয়াজুস্ সালাতীন গ্রন্থেও সরফরাজের তোপখানার কর্মচারী সুজা খাঁর বিশ্বাসঘাতকতায় তোপখানা হইতে গোলাবারুদের পরিবর্তে অনেক ঢিল পাটকেল বাহির হইবার কথা লিখিত আছে। (Riyaz-us-salatin, p. 310.)