পাতা:মৈমনসিংহ গীতিকা (প্রথম খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/৩৮২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩২৪
মৈমনসিংহ-গীতিকা

(১৩)

 কতক্ষণ পরে আবার মন্দিরের কপাট খুইল্যা গেল। কাজলরেখা দেখ্‌ল, কি যে এক সন্ন্যাসী তখন মন্দিরের মধ্যে প্রবেশ কর্‌ল। বাপে কন্যায় এতকাল চেষ্টা করিয়াও যে মন্দিরের কপাট খুলতে পারে নাই, সন্ন্যাসীর হাত কপাটে লাগ্‌বামাত্রই কপাট খুলিয়া গেল। এই দেখিয়া কাজলরেখা ভারি আশ্চর্য্য হইয়া গেল। ভাবিল যে সন্ন্যাসী যাদুকর; নিশ্চয়ই আমার স্বামীকে বাঁচাইতে পারিবে।

 তখন সে সন্ন্যাসীর পায় উপুর হইয়া কান্‌তে লাগ্‌ল। তখন সন্ন্যাসী তারে অভয় দিয়া কইল—“তোমার কোন চিন্তা নাই। এই যে মরা কুমার সে একজন রাজার পুত্র। আমিই তারে এই বনের মধ্যে আইন্যা[১] রাখছি। এর গায়ের সুইচ কাঁটাগুলি তুমি এক একটা কইরা খুল্‌তে থাক। কেবল দুই চক্ষের যে দুইটি সূচ তাহা খুইল্যনা[২]। সমস্ত সূচ তোলা হইলে পরে চক্ষের দুইটি সূচ খুলিয়া এই যে গাছের পাতা দিলাম তার রস চক্ষে দিও তা অইলেই[৩] সে আবার বাঁইচ্যা[৪] উঠবে। কিন্তু সাবধান, তোমার কপালে অনেক দুঃখু আছে; জোর করিয়া কপালের দুঃখু খণ্ডাইতে যাইয়ো না। এই কুমারই তোমার স্বামী, কিন্তু ধর্ম্মমতি শুক যতদিন পর্যন্ত তোমার স্বামীর কাছে তোমার পরিচয় না দেয়, ততদিন পর্যন্ত নিজে খুব দুঃখে পড়িলেও তার কাছে আত্মপরিচয় দিয়ো না। যদি দেও তা হইলে জন্মের মত বিধবা হইবা।” এই বলিয়া সন্ন্যাসী চলিয়া গেল।

 তখন কাজলরেখা সন্ন্যাসীর কথামত সাত দিন সাত রাইত[৫] বসিয়া বসিয়া মরা স্বামীর শরীর হইতে একটী একটী করিয়া সূচগুলি বাছিয়া তুলিল। সাত দিন কাজলরেখা মন্দির হইতে বাইরও হইল না, কিছু খাইলও না। আট দিনের দিন কন্যা কেবল চক্ষের সূচ দুইটা রাইখ্যা ছান[৬] করিবার জন্য জলের সন্ধানে বাইর হইল। কতদূর গিয়া দেখে যে একটা পুষ্কুনী। তার চাইর পারে বান্ধা ঘাট, ডালিমের রসের মত পানি। তখন কন্যা ছান করণের জন্য লামল[৭]। এই সময় পুষ্কুনীর আরেক পার দিয়া ‘ধাই চাই’ বলিয়া একটী লোক যাইতেছিল; তার পাছে একটী কন্যা, তার বয়স ১৩৷১৪ বৎসর। দেখিলে সাধারণ লোকের কন্যা বলিয়াই বোধ হয়। সেই লোকটী কাজলের নিকট আসিয়া দাসী কিনিয়া রাখিবে

  1. আইন্যা=আনিয়া।
  2. খুইল্যনা=খুলিও না।
  3. তা অইলেই=তাহা হইলেই।
  4. বাঁইচ্যা=বাঁচিয়া
  5. রাইত=রাত্রি।
  6. ছান=স্নান।
  7. লামল=নামিল।