পাতা:যোগাযোগ- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৯৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
যোগাযোগ

 “না, সে হবে না—চলো।”

 শেষকালে আবিষ্কার করা গেল, মকরধ্বজের বিশেষ ফল হয়েছে, ক্ষুধার লেশমাত্র অভাব প্রকাশ পেল না।

 কালুদাদাকে খাওয়ানো শেষ হতেই কুমু শোবার ঘরে চলে এল। আজ মনটা বাপের বাড়ির স্মৃতিতে ভরা। এতদিনে নুরনগরে খিড়কির বাগানে আমের বোল ধরেছে। কুসুমিত জামরুল গাছের তলায় পুকুরধারের চাতালে কত নিভৃত মধ্যাহ্নে কুমু হাতের উপর মাথা রেখে এলোচুল ছড়িয়ে দিয়ে শুয়ে কাটিয়েছে—মৌমাছির গুঞ্জনে মুখরিত, ছায়ায় আলোয় খচিত সেই দুপুরবেলা। বুকের মধ্যে একটা অকারণ ব্যথা লাগত, জানত না তার অর্থ কী। সেই ব্যথায় সন্ধ্যেবেলাকার ব্রজের পথের গোখুর-ধূলিতে ওর স্বপ্ন রাঙা হয়ে উঠেছে। বুঝতে পারে নি যে, ওর যৌবনের অপ্রাপ্ত দোসর জলে স্থলে দিয়েছে মায়া মেলে, ওর যুগল রূপের উপাসনায় সেই করেছে লুকোচুরি, তাকেই টেনে এনেছে ওর চিত্তের অলক্ষ্যপুরে এসরাজে মুলতানের মিড়ে মূর্ছনায়। ওর প্রথম-যৌবনের সেই না-পাওয়া মনের মানুষের কত আভাস ছিল ওদের সেখানকার বাড়ির কত জায়গায়, সেখানকার চিলেকোঠায়, যেখান থেকে দেখা যেত গ্রামের বাঁকা রাস্তার ধারে ফুলের আগুন-লাগা সরষেখেত, খিড়কির পাঁচিলের ধারের সেই ঢিবিটা, যেখানে বসে পাঁচিলের ছাতলাপড়া সবুজে কালোয় মেশা নানা রেখায় যেন কোন্ পুরাতন বিস্তৃত কাহিনীর অস্পষ্ট ছবি—দোতালায় ওর শোবার ঘরের জানালায় সকালে ঘুম থেকে উঠেই দূরের রাঙা আকাশের দিকে সাদা পালগুলো দেখতে পেত, দিগন্তের গায়ে গায়ে চলেছে যেন মনের নিরুদ্দেশ কামনার মতো। প্রথম-যৌবনের সেই মরীচিকাই সঙ্গে সঙ্গে এসেছে কলকাতায় ওর পূজার মধ্যে, ওর গানের মধ্যে। সেই তো দৈবের বাণীর ভান করে ওকে

১৯৫