আমার খুব বিশ্বাস যে ‘প্রভাতসংগীতে’ই কবির সমস্ত জীবনের ভাবটির ভূমিকা নিহিত হইয়া আছে। অংশের মধ্যে সম্পূর্ণকে, সীমার মধ্যে অসীমকে নিবিড়রূপে উপলব্ধি করাই রবীন্দ্রনাথের সমস্ত জীবনের সাধনা— আমি পূর্বে বলিয়া আসিয়াছি যে এই সর্বানুভুতিই তাঁহার কাব্যের মূলসুর এবং এই ভাবটি সংগীতের প্রেরণা হইতে একটি নূতন চেতনার মতো তাঁহার মধ্যে বরাবর কাজ করিয়া আসিয়াছে। যদি এ কথা সত্য হয়, তবে স্বীকার করিতেই হইবে যে, দৃষ্টির এই আকস্মিক আবরণ-উন্মোচন, সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এই আনন্দময় উপলব্ধি, এইটি প্রথমে অখণ্ড ভাবে দেখা দিয়া, তার পর জীবনের বিচিত্রতার খণ্ড খণ্ড পথ বাহিয়া আবার ঐ অখণ্ড সৌন্দর্যের দৃষ্টি লাভ করিবার দিকে শেষবয়সে কবিকে তপস্যায় নিযুক্ত রাখিয়াছে।
‘প্রভাতসংগীতে’র আর একটি মাত্র কবিতার আমি এখানে উল্লেখ করিতে চাই, সেটি “প্রতিধ্বনি”। এটি দার্জিলিঙে লেখা। তখন এই আবরণোন্মুক্ত দৃষ্টিটি হারাইয়াছেন। কবিতাটির ভাব এই যে, বস্তুজগতের অন্তরালে যে একটি অসীম অব্যক্ত গীতজগৎ আছে, যেখানে সমস্ত জগতের বিচিত্র ধ্বনি সংগীতে পরিপূর্ণ হইয়া ‘অনাহত শবদে’ নিরন্তর বাজিতেছে— তাহার আভাস, তাহার প্রতিধ্বনি প্রত্যেকটি খণ্ড সৌন্দর্যে খণ্ড সুরে পাওয়া যায়, সেইজন্যই তাহারা প্রাণের মধ্যে এমন সুতীব্র একটি ব্যাকুলতাকে জাগায়। বস্তুত পাখির গান পাখিরই নয়, নির্ঝরের কলশব্দ নির্ঝরেরই নয়, তাহা সেই মূল সংগীতেরই নানা প্রতিধ্বনি— এইজন্যই জগতের যে-সকল সুর ধ্বনিত হইতেছে এবং যাহারা ধ্বনিত হইতেছে না, সকলে মিলিয়া আমাদের মনে একই সৌন্দর্যবেদনাকে জাগাইয়া তুলিতেছে। আমরা নানা প্রতিধ্বনি শুনিতে শুনিতে সেই মূল সংগীতকে শুনিবার জন্য ব্যাকুল হইয়া উঠিতেছি।
৩৩