“স্বর্গ হইতে বিদায়” নামক রবীন্দ্রবাবুর যে পরমাশ্চর্য কবিতাটির উল্লেখ করিলাম তাহার ভিতরের ভাবটি এই:
স্বর্গে কেবলমাত্র আনন্দ, তাহার মধ্যে কোথাও কোনো দুঃখের ছায়ামাত্র পড়ে না। সে আনন্দ যে পৃথিবীর আনন্দ নহে পৃথিবীর ইহাই গৌরব, মানবজীবনের ইহাই গৌরব। পৃথিবীতে আমাদের যে সবই হারাইতে হয়, সেইজন্যই আমাদের এখানকার প্রেম, আমাদের এখানকার আনন্দ এত নিবিড়— স্বর্গে লক্ষ লক্ষ বৎসর চক্ষের পলকটুকুর মতোও নহে, কারণ সেখানে কোনো বৈচিত্র্য নাই, কিন্তু আমাদের পৃথিবীর জীবনের মধ্যে প্রতি মুহূর্তের দেখাশোনা, কথাবার্তা, মেলা মেশা কি বেদনাময়, প্রেমের দ্বারা কি নিবিড় রহস্যময়! তাই—
স্বর্গে তব বহুক অমৃত,
মর্তে থাক্ সুখে-দুঃখে-অনন্ত-মিশ্রিত
প্রেমধারা অশ্রুজলে চিরশ্যাম করি
ভূতলের স্বর্গখণ্ডগুলি।
সোনার তরীর পরশপাথর, দেউল প্রভৃতি কবিতায় যে বাস্তব জগৎ হইতে, জীবন হইতে বিমুখ হইবার ভাবের প্রতিবাদ দেখিতে পাওয়া যায় তাহা প্রকৃতপক্ষে আমাদের দেশের মজ্জাগত বৈরাগ্যেরই প্রতিবাদ। জগৎটাকে মায়া ছায়া, সংসারকে অনিত্য, স্নেহপ্রেমকে মোহ বলিয়া ঘোষণা করিবার জন্য আমরা পরশপাথরের সন্ন্যাসীর মতো সকল হইতে বিচ্ছিন্ন একটা কাল্পনিক ভাবের মধ্যে থাকিয়া মাটি হইতে উপড়াইয়া-ফেলা গাছের মতো শুকাইয়া মরি। সেই শুষ্কতার সাধনাকেই আবার আমরা অদ্বৈতের সাধনা, মুক্তির সাধনা বলিয়া গর্ব করিয়া থাকি। যেন অদ্বৈত একটা মনের ভাব মাত্র, তাহার বাস্তবিক সত্তা কিছুই নাই।
৪৮