পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৩৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8२२ রবীন্দ্র-রচনাবলী দেওয়া । বাতাস না থাকিলে মধ্যাহ্নকালেও কোথাও বা প্রখর আলোক কোথাও বা নিবিড়তম অন্ধকার বিরাজ করিত । আমাদের জ্ঞানরাজ্যের মনোরাজ্যের চারিদিকেও সেইরূপ একটা বায়ুমণ্ডলের আবশ্যকতা আছে৮লমাজের সর্বত্র ব্যাপ্ত করিয়া এমন একটা অসুশীলনের হাওয়া বহা চাই যাহাতে জ্ঞান এবং ভাবের রশ্মি চতুর্দিকে প্রতিফলিত বিকীর্ণ হইতে পারে। যখন বঙ্গদেশে প্রথম ইংরেজিশিক্ষা প্রচলিত হয়, যখন আমাদের সমাজে সেই মানসিক বায়ুমণ্ডল স্বজিত হয় নাই, তখন শতরঞ্জের সাদা এবং কালো ঘরের মতো শিক্ষা এবং অশিক্ষা পরস্পর সংলিপ্ত না হইয়া ঠিক পাশাপাশি বাস করিত । যাহারা ইংরেজি শিখিয়াছে এবং যাহারা শেখে নাই তাহারা মুস্পষ্টরূপে বিভক্ত ছিল— তাহাদের পরস্পরের মধ্যে কোনোরূপ সংযোগ ছিল না, কেবল সংঘাত ছিল। শিক্ষিত ভাই আপন অশিক্ষিত ভাইকে মনের সহিত অবজ্ঞা করিতে পারিত কিন্তু কোনো সহজ উপায়ে তাহাকে আপন শিক্ষার অংশ দান করিতে পারিত না । কিন্তু দানের অধিকার না থাকিলে কোনো জিনিসে পুরা অধিকার থাকে না। কেবল ভোগশ্বত্ব এবং জীবনস্বত্ব নাবালক এবং স্ত্রীলোকের অসম্পূর্ণ অধিকার মাত্র। এক সময়ে আমাদের ইংরেজি-পণ্ডিতের মস্ত পণ্ডিত ছিলেন কিন্তু তাহাদের পাণ্ডিত্য র্তাহাদের নিজের মধ্যেই বদ্ধ থাকিত, দেশের লোককে দান করিতে পারিতেন না—এইজন্য সে পাণ্ডিত্য কেবল বিরোধ এবং অশাস্তির স্বষ্টি করিত। সেই অসম্পূর্ণ পাণ্ডিত্যে কেবল প্রচুর উত্তাপ দিত কিন্তু যথেষ্ট আলোক দিত না। এই ক্ষুদ্র সীমায় বদ্ধ ব্যাপ্তিহীন পাণ্ডিত্য কিছু অত্যুগ্র হইয় উঠে ; কেবল তাহাই নছে, তাহার প্রধান দোষ এই যে, নবশিক্ষার মুখ্য এবং গৌণ অংশ সে নির্বাচন করিয়া লইতে পারে না। সেইজন্য প্রথম-প্রথম র্যাহারা ইংরেজি শিথিয়াছিলেন তাহারা চতুষ্পাশ্ববতীদের প্রতি অনাবশ্বক উৎপীড়ন করিয়াছিলেন এবং স্থির করিয়াছিলেন মন্ত মাংস ও মুখরতাই সভ্যতার মুখ্য উপকরণ। চালের বস্তার চাল এবং কাকর পৃথক বাছিতে হইলে একটা পাত্রে সমস্ত ছড়াইয়া ফেলিতে হয়—তেমনি নবশিক্ষা অনেকের মধ্যে বিস্তারিত করিয়া না দিলে তাহার শস্ত এবং কঙ্কর অংশ নির্বাচন করিয়া ফেলা দুঃসাধ্য হইয়া থাকে। অতএব প্রথম-প্রথম যখন নূতন শিক্ষায় সম্পূর্ণ ভালো ফল না দিয়া নানাপ্রকার অসংগত আতিশয্যের স্বষ্টি করে তখন অতিমাত্র ভীত হইয়া সে-শিক্ষাকে রোধ করিবার চেষ্টা সকল সময়ে সদবিবেচনার কাজ নহে। যাহা স্বাধীনভাবে ব্যাপ্ত হইতে পারে তাহা আপনাকে আপনি সংশোধন করিয়া লয়, যাহা বদ্ধ থাকে তাহাই দূষিত হইয়া উঠে।